হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য এবং হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের কারণ গুলি কি কি

 

হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য এবং হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের কারণ গুলি কি কি

হরপ্পা সভ্যতা

 

হরপ্পা-সভ্যতার-বৈশিষ্ট্য-এবং-হরপ্পা-সভ্যতা-ধ্বংসের-কারণ-গুলি-কি-কি

 

হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার :

  প্রাচীন বিশ্বের বিভিন্ন নদী উপত্যকায় তাম্র-প্রস্তর যুগে উন্নত সভ্যতার উদ্ভব হয়। মিশরে নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর তীরে সুমেরীয় সভ্যতা এবং ভারতে সিন্ধু নদীর উপত্যকায় হরপ্পা সভ্যতা একই সময়ে বিকশিত হয়। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহানী সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদড়াে ও পাঞ্জাবে মন্টোগােমারি জেলার হরপ্পায় এক প্রাচীন উন্নত সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন। মহেঞ্জোদড়াে কথার অর্থ মৃতের স্তুপ। এই আবিস্কারের সঙ্গে জন মার্শাল, স্যার মার্টিমার হুইলার, কাশীনাথ দীক্ষিত প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদগণের নাম জড়িয়ে আছে। এই সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্র হল মহেঞ্জোদড়াে এবং হরপ্পা। এই দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৪৮৩ কিলােমিটার হলেও এই সুপ্রাচীন সভ্যতা একই সময়ের এবং একই সভ্যতা সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সিন্ধুনদের তীরে প্রথম এই দুটি স্থানে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল বলে এই সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হত। এই সভ্যতার সাতটি স্তর আবিষ্কৃত হয়েছিল। এতে অনুমান করা হয়, বারংবার এই সভ্যতা পুনর্গঠিত হয়েছিল।

 

০ ব্যাপ্তি :

  পরবর্তীকালে ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রায় ২৫০টি স্থানে এই একই সভ্যতার নিদর্শন আবিস্কৃত হয়। সেইজন্য এই সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়। হরপ্পা সভ্যতা ভারতের এক বিরাট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এই ২৫০টি কেন্দ্রগুলির মধ্যে ছয়টি নগর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিন্ধু প্রদেশে মহেঞ্জোদড়াে ও চানহু দড়াে, পাঞ্জাবে হরপ্পা, গুজরাটের লােথাল, হরিয়ানার রূপার, বনওয়ালি উত্তর প্রদেশের নিকটে আলমগীরপুর, রাজস্থানের কালিবঙ্গান, বেলুচিস্তানে সুত কাজেনদরাে প্রভৃতি স্থানে হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গ কিলােমিটার ব্যাপী এই সভ্যতার বিস্তার হয়েছিল। প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে হরপ্পা সভ্যতার ব্যাপ্তি ছিল সর্বাধিক। প্রাচীনত্ব :

  হরপ্পা সভ্যতার প্রাচীনত্ব নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। হরপ্পা সভ্যতার প্রাচীনত্ব নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও এই সভ্যতার কাল সীমা খ্রিঃ পূঃ ৩০০০ থেকে খ্রিঃ পূর্ব ১৫০০ অব্দকেই মেনে নেওয়া যেতে পারে।

হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য এবং হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের কারণ গুলি কি কি

স্রষ্টা :

 হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা কারা? সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কোন নগােষ্ঠী প্রকৃত স্রষ্টা তা সঠিক সিদ্ধান্ত করা যায় না। অনেকে দ্রাবিড় জাতিকে হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা বলে মনে করেন। ধ্যাপক এ, এল ব্যাসামের মতে হরপ্পা সভ্যতা ভারতীয়দেরই সৃষ্টি।

 

হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য :

 

তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা –

   হরপ্পা সভ্যতা প্রাগৈতিহাসিক ও তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে পাথরের ব্যবহার কমে আসতে থাকে। এই সময় তামার ও তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জ এবং পাথরের দ্রব্যাদির ব্যবহার চলতে থাকে। এই যুগে মানুষ লােহার ব্যবহার জানত না। মেসােপটেমিয়া ও মিশরীয় সভ্যতাও তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা ছিল।

 

 নদীমাতৃক সভ্যতা-

 বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির মত (যথা – সুমের, আক্কাদ, মিশর, ব্যাবিলন) হরপ্পা সভ্যতা নদীমাতৃক সভ্যতা। এই সভ্যতা সিন্ধু উপত্যকায় গড়ে ওঠে। হরপ্পা সভ্যতা সিন্ধু উপত্যকা অতিক্রম করে পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, গুজরাট, রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশের মীরাট পর্যন্ত এবং উত্তরে জম্মু থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।

 

 

নগর সভ্যতা-

 

হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা ছিয়টি নগরকে কেন্দ্র করে এই সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। এই নগরগুলি হল হরপ্পা, মহেঞ্জোদড়াে, চানহুড়াে, লােথাল, কালিবঙ্গন ও বনওয়ালি। এই নগরগুলিতে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে জানা যায় নগরগুলির মধ্যে দূরত্ব থাকলেও একই ধরনের নগর পরিকল্পনা, রীতিনীতি ও জীবন যাত্রা ছিল। নগরবাসীরা নগরের সুযােগ সুবিধা ভােগ করত। হরপ্পার নগর সভ্যতার আধুনিক নগর পরিকল্পনার সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। মূলত ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই এই নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

 

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা –

 হরপ্পা সভ্যতায় প্রধান নগর ছিল মহেঞ্জোদড়াে ও হরপ্পা। নগর দুটির

মধ্যে নদীপথে যােগাযােগ ছিল। হরপ্পা সভ্যতাভুক্ত নগরগুলির নির্মাণকৌশল ও স্থাপত্যবিদ্যা, নাগরিক স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধার প্রতি লক্ষ রেখে নগর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়াে নগর দুটোই ছিল ঘনবসতি পূর্ণ এবং নিপুণভাবে পরিকল্পিত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়াে দুটি শহরের গঠনরীতি ও পরিকল্পনা একই রকমের ছিল।

 

নগরদুর্গ ও শস্যাগার :

 

 নগরের উঁচু স্থানে নগর দুর্গ ছিল। এখানে সম্ভবত শাসকশ্রেণি বাস করত। এই দুর্গের আশে পাশে বড়াে বড়াে ইমারত গুলিতে প্রশাসনিক কাজকর্ম হত। নগর দুর্গের নীচে ছিল সাধারণ নগরাঞ্চল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়াে দুটি শহরে শস্যাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। মহেঞ্জোদড়াের শস্যাগারটির আয়তন দৈর্ঘ্যে ২০০ ফুট এবং প্রস্থে ১৫০ ফুট ছিল। হরপ্পার শস্যাগারটি নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে শস্য সংগ্রহ করে নদীপথে এই শস্যাগারে জমা হত। এই শস্যাগারগুলি শস্য ব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহৃত হত। ইতিপূর্বে এধরনের শস্যাগার পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায়নি। বন্যা হলে এই শস্যাগার থেকেই শস্য নাগরিকদের দেওয়া হত। 

 

 স্নানাগার :

 মহেঞ্জোদড়াের নগর দুর্গের বাইরে এক বিশাল স্নানাগার পাওয়া গিয়েছে। এই

 

স্নানাগারের আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৮০ ফুট ও প্রস্থে ১০৮ ফুট। এর চারিদিকে ৮ ফুট উঁচু পাঁচিল ছিল। স্নানাগারের কেন্দ্ৰথলে ছিল একটি জলাশয়। এই জলাশয়টি ৩৯ ফুট লম্বা, ২৩ ফুট চওড়া ও ৮ ফুট গভীর ছিল। এই জলাশয়ের নােংরা জল নিষ্কাশন করা । এবং পরিস্কার জল সরবরাহ করার সুব্যবস্থা ছিল। ঋতুভেদে গরম জল ঠান্ডা জল সরবরাহ করা হত।

 

বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, জলনিকাশী ব্যবস্থা : 

 নগরের পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল কয়েকটি পাকা রাস্তা ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়াের রাস্তাগুলি ৯ ফুট থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া ছিল। রাস্তাগুলাে পূর্ব পশ্চিম ও উত্তর দক্ষিণ দিকে পরস্পরকে সমকোণে খণ্ডিত করে নগরকে কয়েকটি আয়তক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি পােড়া ইটের তৈরি একতলা, দোতলা এমনকি তিনতলা বাড়ি ছিল। প্রধান রাস্তার পাশে গলি পথে গৃহের প্রবেশদ্বার ছিল। ছােটো বড়াে সব বাড়িতে কুয়াে ও স্নানাগার ছিল। বাড়ি থেকে ময়লা জল নিষ্কাশিত হয়ে বড়াে রাস্তার নর্দমায় পড়ত। বড়াে রাস্তার ধারে ঢাকা নর্দমা ছিল। নদৰ্মার আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য ম্যানহােল থাকত। রাস্তার ধারে ডাস্টবিন ছিল। সারিবদ্ধ ছােটো ছােটো কুঠরি ঘরে শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষরা বাস করত। শহরের স্বাস্থ্য সচেতনা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি শাসকদের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়াে শহরে কোনাে দেবালয় বা মন্দির পাওয়া যায়নি। 

 

হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক জীবনঃ

 

O শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ও হরপ্পা সভ্যতার প্রাপ্ত নিদর্শনগুলি দেখে এই সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা ধে পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, হরপ্পা সভ্যতায় শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ছিল। বড়াে ও ছােটো বাড়ি অন্য নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় যে, শহরে দ্বিতল গৃহগুলিতে ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাস রত, ছােটো ছােটো খুপরি ঘরগুলিতে শ্রমিক ও দরিদ্ররা বাস করত। এছাড়া কৃষকশ্রেণি ছিল। 1 দুর্গে শাসকশ্রেণি থাকত। শস্যাগারের নিকট শ্রমিকরা বাস করত। শ্রমিকরা এখানে ভারী বােঝা বহন করত ও শহর পরিষ্কার রাখত।

 

 খাদ্য, পশু, পােশাক পরিচ্ছদ :

 

  শস্য ভাণ্ডারের নিদর্শন দেখে মনে হয়, সিন্ধুবাসী প্রধানত কৃষিজীবী ছিল। নগর দুইটির পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমিতে চাষাবাদ হত । সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, বার্লি, তিল, মটর, রাই, দুধ, মাছ, মাংস প্রভৃতি। মাটির তৈরি পশু পাখির খেলনা দেখে জানা যায় সিন্ধু অঞ্চলের অধিবাসীরা গােরু, শূকর, উট, ভেড়া, ছাগল, কুকুর প্রভৃতি গৃহপালিত পশু পালন করত। এছাড়া হাঁস মুরগি, টিয়া, ময়ুর প্রভৃতি পালন করত। মাটির তৈরি বাঘ, ভাল্লুক, গন্ডার, বানর, খরগােশ প্রভৃতি পাওয়া গিয়েছে। তবে এই যুগে ঘােড়ার ব্যবহার ছিল না। হরপ্পাবাসীরা সূতী ও পশমের বস্ত্র ব্যবহার করত। তারা দেহের উপরের অংশে এক খণ্ড বস্ত্র ও নিম্ন অংশে এক খণ্ড বস্ত্র ব্যবহার করত। নারী পুরুষ উভয়ই অলঙ্কার পরত ও লম্বা চুল রাখত। তামা, ব্রোঞ্জ, সােনা, রূপা ও পাথরের তৈরি হার, চুড়ি, মল, দুল, কোমরবন্ধ ও মালা প্রভৃতি অলংকার ব্যবহৃত হত।

 

গৃহস্থালির সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র, বিনােদন:

 

 ও মাটি, তামা, ব্রোঞ্জ, পাথরের তৈরি বাসনপত্র ও গৃহস্থালির সরঞ্জাম পাওয়া গিয়েছে। মৃৎশিল্পীগণ জালা, কলসী, থালা প্রভৃতির পাশাপাশি নানা ধরনের পুতুল, খেলনা, দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করত। তামা, ব্রোঞ্জ, পাথরের তৈরি বর্শা, কুঠার, মুষল, তির প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার হত। কিন্তু শিরস্ত্রাণ, ঢাল, বর্ম প্রভৃতি আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র পাওয়া যায়নি। আমােদ প্রমােদের জন্য ছিল রথচালনা, পাশাখেলা, শিকার, নৃত্যগীত প্রভৃতি।

 

 হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন ঃ 

হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবনে বহু জীবিকার সন্ধান পাওয়া যায়। কৃষিকাজে বেশি লােক যুক্ত ছিল। এছাড়া মহেঞ্জোদড়াের শিল্প নিদর্শন। হরপ্পাবাসীরা পশুপালন, শিল্প ও কারিগরি এবং ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যকলাপে  যুক্ত ছিল।

 

কৃষি ও অন্যান্য শিল্প :

 

সিন্ধু অঞলে পলিমাটি যুক্ত উর্বর জমিতে গম, বার্লি, রাই, মটর, তুলাের উৎপাদন হত। তাঁতিরা পশম ও সূতির বস্ত্র উৎপাদন করত। কুমােরের চাকা ব্যবহার করে দক্ষ মৃৎশিল্পীরা মাটির কলসি ও গৃহস্থালির দ্রব্য, মুর্তি, খেলনা তৈরি করত। এই যুগের তৈরি তামা ও ব্রোঞ্জের অস্ত্রশস্ত্র যন্ত্রপাতি, কুড়ুল, বঁড়শি প্রভৃতি আবিস্কৃত হয়। সােনা ও রূপার অলংকার প্রস্তুত হত। ছুতাের, রাজমিস্ত্রি ও অলংকার শিল্পীরা এযুগে বাস করতেন। 

 

ব্যাবসা বাণিজ্য ও যানবাহন ঃ 

 

এই যুগে থল পথে ও জল পথে সিন্ধুবাসীরা ব্যবসা বাণিজ্য করত। হরপ্পা নগরগুলির সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের যােগাযােগ ও বাণিজ্যের সম্পর্কের কথা জানা যায়। যানবাহন হিসাবে উট, গাধা, দু-চাকা বিশিষ্ট গরু ও ষাঁড়ের গাড়ি, নৌকা ব্যবহার হত। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সঙ্গে ক্রীট, সুমের, ইরাণ, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, রাজস্থান এবং দেশীয় নগরগুলির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল। ঐ সব দেশে হরপ্পা অঞ্চলের সিলমােহর পাওয়া গেছে। সম্ভবত সিলমােহরগুলি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হত। বিদেশ থেকে সােনা, রূপা, টিন, তামা আমদানি করা হত। সিন্ধু উপত্যকা থেকে তুলাে, হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসপত্র, সূতীবস্ত্র রপ্তানি করা হত। রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান পণ্য ছিল সৃতিবস্ত্র। লােথাল ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম বন্দর।

 

O সিল মােহর ও লিপি ও সিন্ধু সভ্যতায় পােড়া মাটি, তামা ও ব্রোঞ্জের প্রচুর সিলমােহর। পাওয়া গিয়েছে। এই সিলমােহরে জীবজন্তু, জলযান * * ও মূর্তির চিত্র অঙ্কিত আছে। এই সিলমােহরে চিত্রলিপি |& k এর উৎকীর্ণ রয়েছে। এই সিধুলিপি আজ পর্যন্ত পাঠোন্ধার করা সম্ভব হয়নি।

 

 ধর্মীয় জীবনঃ

 

হরপ্পা সভ্যতায় কোনাে দেবালয় আবিষ্কৃত হয়নি। শক্তি রূপে মাতৃদেবীর পূজা হত। পশু পরিবৃত দুটি শিং ও ত্রিমুখবিশিষ্ট ধ্যানমগ্ন এক যােগীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। অধ্যাপক ব্যাসাম এটিকে আদি পশুপতি শিব বলে অভিহিত করেছেন। সিন্ধুবাসীরা গাছ, আগুন, জল, পশুপতি জীবজন্তু ও সূর্যের উপাসনা করত। বৃক্ষের মধ্যে পিপল বৃক্ষকে এরা পবিত্র জ্ঞান করতাে। বৃষ ছিল এদের শ্রদ্ধার বস্তু। পুরােহিতশ্রেণি ছিল কিনা সঠিক জানা যায় না।

 

বিশ্বের সমকালীন নগর সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার  সম্পর্ক :-

 

হরপ্পা সভ্যতার সমকালে মিশর, সুমের ও মেসােপটেমিয়ায় উন্নত সভ্যতার বিস্তার হয়েছিল। এই সভ্যতাগুলাে ছিল নদীমাতৃক। ঐ সকল সভ্যতার সঙ্গেহরপ্পা সভ্যতা সাদৃশ্য থেকে ঐতিহাসিকরা মনে করেন হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে এই সকল প্রাচীন সভ্যতার যােগাযােগ ছিল। বাণিজ্যিক আদান প্রদান ছিল। বাণিজ্যিক সম্পর্কের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যােগাযােগ পরস্পরকে প্রভাবিত করেছিল। বিশ্বের অন্যান্য সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার সম্পর্কের প্রমাণগুলি হল ঃ (১) সুমেরমেসােপটেমিয়ার লিপির সঙ্গে সিন্ধু লিপির সাদৃশ্য রয়েছে। (২) মিশর, মেসােপটেমিয়া ও সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগর সভ্যতা। (৩) এই সকল স্থানে পােড়ামাটির ইটের তৈরি পাকা বাড়ি ছিল। (৪) এই সভ্যতাগুলি ছিল তা-ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। (৫) পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলিতে হরপ্পা অঞ্চল থেকে প্রচুর সূতীবস্ত্র যেত। সুমের ও সিন্ধু সভ্যতায় একই ধরনের সিলমােহর পাওয়া গেছে। মিশরের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার পরােক্ষ সম্পর্ক ছিল বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। এছাড়া আফগানিস্তান ও ক্রীট সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যােগাযােগ থাকলেও হরপ্পা সভ্যতা ছিল স্বতন্ত্র। এই নদী কেন্দ্রিক সভ্যতাগুলির মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। মেসােপটেমিয়া ও সিন্ধু সভ্যতায় পােড়া মাটির ইটের ব্যবহার ছিল। মিশরে রােদে পােড়া ইটের ব্যবহার ছিল। হরপ্পা সভ্যতার মত পরিকল্পিত শহর অন্য কোথাও ছিল না। কীট সভ্যতার উন্নত পয়ঃপ্রণালী ছিল। অধ্যাপক ব্যাসাম বলেছেন যে হরপ্পা সভ্যতা সুমেরীয় প্রভাব মুক্ত। প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে জলপথে ও স্থলপথে যােগাযােগ ছিল।

 

হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের কারণ :-

 

হরপ্পা সভ্যতা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের পর থেকেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে থাকে। এই সভ্যতার আবক্ষয় দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। এই সভ্যতার অবসানের কারণ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মত রয়েছে। এই কারণগুলি হল প্রথমত, নগরের গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে পৌর সংস্থার যে কঠোরতা ছিল, তা শিথিল হওয়ায় বাড়িগুলি রাস্তার উপর এসে পড়েছিল। ফলে নিকাশি ও জল সরবরাহ ভেঙ্গে পড়ে। শহরের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নগর জীবন বিপর্যস্ত হয়। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক কারণে ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, নদীর গতি পরিবর্তন, প্রভৃতি কারণে এই সভ্যতা ধ্বংস হয় বলে অনুমান করা হয়। তৃতীয়ত, অনেকে বলেন বারবার সিন্ধু নদীর বন্যা মহেঞ্জোদড়াে নগরকে গ্রাস করত। বন্যা প্রতিরােধের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। চতুর্থত, পােড়া ইটের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে বৃক্ষছেদন করা হত ফলে বনশূন্যতার কারণে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় খরার সৃষ্টি হয়। পঞ্চমত, জলবায়ু পরিবর্তন ও রাজস্থানের মরুভূমির সম্প্রসারণের ফলে এই স্থান জনশূন্য হয়ে পড়ে। ষষ্ঠত, জলসেচ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পায় ফলে খাদ্যের অভাব ও দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সপ্তমত, অনেকে বলেন অতর্কিতে বৈদেশিক আক্রমণে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়। মহেঞ্জোদাড়ােতে স্থূপীকৃত মৃতদেহ এবং পলায়ন পর মানুষের মৃতদেহ প্রকাশ্য স্থানে পড়ে ছিল। এই মৃতদেহের মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। কেউ বলেন আর্যদের আক্রমণে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়।  কেউ বলেন আর্যদের আক্রমণের বহু পূর্বেই গৃহযুদ্ধের ফলে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *