History Class X

মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস এর খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্তর ||

মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস এর খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্তর ||

মাধ্যমিক-2026-ইতিহাস

এই আর্টিকেলটিতে মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস এর খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্তর ||মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা। বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন উত্তর আলোচনা করা হয়েছে 

 

Table of Contents

মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২) ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এই আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা আন্দোলনটিকে গণ-আন্দোলনের রূপ দিতে সাহায্য করেছিল।

✊ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা (৮ নম্বর)

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনায় বেশিরভাগ জাতীয় স্তরের নেতা গ্রেফতার হওয়ায়, শ্রমিক শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দেয় এবং নিজেদের প্রতিবাদ জানাতে ধর্মঘট ও শ্রমিক অসন্তোষের পথ বেছে নেয়।

১. স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট ও উৎপাদন বন্ধ (Spontaneous Strikes)

* ব্যাপক ধর্মঘট: ১৯৪২ সালের আগস্ট মাস থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকরা ব্যাপক সংখ্যায় কাজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এই ধর্মঘট ছিল মূলত স্বতঃস্ফূর্ত।

* দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবাদ: আহমেদাবাদে শ্রমিকরা টানা ১০৫ দিন কাজ বন্ধ রাখে, যা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রমিকদের দীর্ঘতম ধর্মঘটগুলির মধ্যে অন্যতম। জামশেদপুরের টাটা ইস্পাত কারখানার শ্রমিকরা ১৩ দিন ধরে ধর্মঘট করে।

* উৎপাদন ব্যাহত: এই লাগাতার ধর্মঘটের ফলে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্রিটিশ সরকারের সামরিক উৎপাদন ও শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

২. রাজনৈতিক চেতনা ও স্লোগান (Political Consciousness)

* শ্রমিকরা শুধুমাত্র মজুরি বা কর্মজীবনের দাবি নিয়ে ধর্মঘট করেনি, বরং তারা সরাসরি রাজনৈতিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে।

* তাদের মিছিলে “ভারত ছাড়ো”, “করব অথবা মরব” এবং “গান্ধীজির জয়”-এর মতো জাতীয়তাবাদী স্লোগান শোনা যেত, যা তাদের জাতীয় আন্দোলনের প্রতি গভীর অঙ্গীকার প্রকাশ করে।

৩. আঞ্চলিক সক্রিয়তা ও সংহতি (Regional Activism)

* বোম্বাই, কলকাতা, মাদ্রাজ, কানপুর, আহমেদাবাদ এবং জামশেদপুরের মতো প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল।

* বোম্বাইয়ের বস্ত্র শ্রমিকরা ও টাটা ইস্পাত কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই শ্রমিকরা স্থানীয়ভাবে নিজেদের নেতা তৈরি করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

৪. কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান (The Role of the CPI)

* আন্দোলনের প্রথম দিকে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (CPI) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, কারণ তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ নেয় এবং এটিকে “জনযুদ্ধ” বলে ঘোষণা করে।

* তবে, বহু সাধারণ কমিউনিস্ট সমর্থক শ্রমিক নেতৃত্ব দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে দেশজুড়ে ধর্মঘট ও প্রতিবাদে অংশ নেয়।

৫. দমন-পীড়ন ও বলিদান (Repression and Sacrifice)

* ব্রিটিশ সরকার শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে অত্যন্ত কঠোর হাতে দমন করে। বহু শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং অনেক জায়গায় নির্বিচারে গুলিও চালানো হয়।

* এই দমন-পীড়ন সত্ত্বেও শ্রমিকরা সহজে হাল ছাড়েনি। তাদের এই প্রতিরোধ প্রমাণ করে যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল।

✍️ মূল্যায়ন (Conclusion)

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সরাসরি আন্দোলনে সমর্থন জানায়নি, তবুও সাধারণ শ্রমিকদের ধর্মঘট, উৎপাদন ব্যাহত করা এবং ব্রিটিশ বিরোধী স্লোগান দেশের মুক্তি আন্দোলনকে আরও জোরদার করেছিল।

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ১৯৪২ সালের বিদ্রোহ শুধুমাত্র শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং শ্রমিক শ্রেণি সহ সমাজের নিম্নবর্গের মানুষেরাও এতে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল, যা আন্দোলনের গণচরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করে।

——-

স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা কি ছিল?

স্বাধীনতার পর ৫৬২টিরও বেশি দেশীয় রাজ্যকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা ছিল নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই কঠিন কাজটি যিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা ও বাস্তবসম্মত কৌশলের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন, তিনি হলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাঁর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাই তাঁকে ভারতের ‘লৌহমানব’ (Iron Man of India) উপাধি এনে দেয়।

🗝️ দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা:

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে প্যাটেলের ভূমিকা ছিল নীতিগত, আইনি ও প্রশাসনিক কৌশল এবং প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপের এক অনন্য সংমিশ্রণ।

১. স্বরাষ্ট্র এবং দেশীয় রাজ্য মন্ত্রকের প্রধানের দায়িত্ব (Minister of States)

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক আগে, দেশীয় রাজ্যগুলির সমস্যা সমাধানের জন্য দেশীয় রাজ্য মন্ত্রক (States Department) গঠিত হয়। এই মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে এবং তাঁর সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন ভি. পি. মেনন। এই প্রশাসনিক ক্ষমতাই প্যাটেলকে রাজ্যের প্রধানদের সাথে সরাসরি আলোচনার মঞ্চ তৈরি করে দেয়।

২. প্যাটেলের ‘লৌহমানব’ নীতি: কৌশল ও দৃঢ়তা

প্যাটেল তিনটি প্রধান নীতির ভিত্তিতে দেশীয় রাজ্যগুলির সমস্যা মোকাবিলা করেন:

* আপিল ও বোঝাপড়া: তিনি দেশীয় রাজাদের সামনে ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং তাঁদের দেশপ্রেমের প্রতি আবেদন জানান। তিনি আশ্বাস দেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সুযোগ-সুবিধা বজায় থাকবে।

* শক্ত হাতে মোকাবিলা: যে রাজ্যগুলি যুক্ত হতে অস্বীকার করে বা বিরোধিতা করে, প্যাটেল তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। তাঁর নীতি ছিল “গাজর এবং লাঠি” (Carrot and Stick)-এর মিশ্রণ।

* ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা: তিনি রাজাদের বোঝান যে ভারত বা পাকিস্তানের যেকোনো একটির সাথে যুক্ত হওয়া ছাড়া তাদের সামনে স্বাধীন থাকার কোনো বাস্তব বিকল্প নেই।

৩. ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন (Instrument of Accession – IoA) প্রয়োগ

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল ছিল ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন’ (বিলয়পত্র)।

* প্যাটেল ও ভি. পি. মেনন এই দলিলটি তৈরি করেন। এর মাধ্যমে রাজারা কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ—এই তিনটি বিষয় ভারত সরকারের হাতে তুলে দিতে সম্মত হন।

* প্যাটেলের দ্রুত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যেই প্রায় সমস্ত রাজ্য এই দলিলে স্বাক্ষর করে ভারতের অংশ হয়ে যায়।

৪. তিনটি জটিল রাজ্যের সমাধান: চূড়ান্ত সাফল্য

তিনটি রাজ্য, যেখানে সমস্যা সবচেয়ে তীব্র ছিল (জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর), সেখানে প্যাটেল কার্যকর কৌশল প্রয়োগ করেন:
| রাজ্য | সমস্যার প্রকৃতি | প্যাটেলের কৌশল | ফলাফল |
|—|—|—|—|

| জুনাগড় | মুসলিম নবাব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জনগণ ভারতে থাকতে চেয়েছিল। | নবাবের অনুপস্থিতিতে জনগণের দাবিতে গণভোট (Plebiscite) অনুষ্ঠিত হয়। | জুনাগড় ভারতে যুক্ত হয় (১৯৪৮)। |

| হায়দ্রাবাদ | নিজাম সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন এবং সশস্ত্র প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। | ‘অপারেশন পোলো’ (Operation Polo) নামে সামরিক অভিযান চালানো হয়। | নিজামের বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং হায়দ্রাবাদ ভারতে যুক্ত হয় (১৯৪৮)। |

| কাশ্মীর | পাকিস্তান সমর্থিত উপজাতিদের আক্রমণে মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগদানে বাধ্য হন। | হরি সিংকে বিলয়পত্রে স্বাক্ষর করানোর পর ভারতীয় সৈন্য পাঠানো হয়। | রাজ্যটি ভারতে যুক্ত হয়। (এই ক্ষেত্রে নেহেরু এবং প্যাটেল উভয়ই জড়িত ছিলেন, তবে বিলয়পত্র সম্পাদনে প্যাটেলের নীতি কাজ করেছিল)। |

৫. রাজ্যগুলির পুনর্গঠন (Reorganisation of States)

বিলয়পত্র স্বাক্ষরের পর প্যাটেলের কাজ শেষ হয়নি। তিনি এরপর ছোট ছোট দেশীয় রাজ্যগুলিকে কাছাকাছি অবস্থিত বড় প্রদেশগুলির সাথে মিশিয়ে দিয়ে অথবা নতুন রাজ্য (যেমন সৌরাষ্ট্র ইউনিয়ন) তৈরি করে প্রশাসনিক পুনর্গঠন শুরু করেন। এটি ভারতের বর্তমান রাজ্য কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

⭐ মূল্যায়ন: একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্ব ছাড়া দেশীয় রাজ্যগুলির শান্তিপূর্ণ ও দ্রুত ভারতভুক্তি প্রায় অসম্ভব ছিল। তাঁর বাস্তববাদী, বিচক্ষণ এবং প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপই ভারতীয় ইউনিয়নকে একটি অখণ্ড ও সুসংহত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

এই কারণেই আধুনিক ভারতের ইতিহাসে তাঁর এই কৃতিত্বকে ‘দ্বিতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা’ (Second Unification of India) হিসেবে গণ্য করা হয়, যা তাঁকে এক অবিস্মরণীয় নেতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

——-

আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব: মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস

আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সরকারি নথিপত্র (Government Documents) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য উপাদান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন তাদের শাসন, নীতি ও সিদ্ধান্তগুলির রেকর্ড বজায় রাখত, যা ১৮শ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য অপরিহার্য।

📜 আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব

সরকারি নথিপত্র বলতে মূলত প্রশাসন কর্তৃক লিখিত চিঠিপত্র, রিপোর্ট, আইন, গেজেট, সরকারি ঘোষণা, নীতি ও বিচারালয়ের নথিকে বোঝায়। এই নথিপত্রগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো:

১. ঔপনিবেশিক শাসনের স্বরূপ উদঘাটন

* নীতি ও উদ্দেশ্য: সরকারি নথিপত্রগুলি ব্রিটিশ সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য, নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়া ও আইনগত ভিত্তি উন্মোচন করে। যেমন—বিভিন্ন আইন (Acts), রেগুলেশন (Regulations), এবং সরকারি শিক্ষা কমিশন বা ভূমি রাজস্বের রিপোর্ট (যেমন: হান্টার কমিশন রিপোর্ট, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নথি) থেকে ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো বোঝা যায়।

* দমন-পীড়ন: বিদ্রোহ বা গণ-আন্দোলন দমনের ক্ষেত্রে সরকারের দমনমূলক কৌশল এবং অভ্যন্তরীণ আলোচনা এই নথিগুলিতে প্রকাশিত হয়।

২. সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিত্রায়ণ

* অর্থনৈতিক তথ্য: রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত নথি, ভূমি জরিপ ও বন্দোবস্তের রেকর্ড, বাণিজ্য সংক্রান্ত গেজেট এবং শুল্ক বিভাগীয় রিপোর্ট তৎকালীন ভারতের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরে।

* জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা: জনস্বাস্থ্য, মহামারী নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার (যেমন—বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতিষ্ঠার দলিল), এবং স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলির তথ্য এই নথিপত্রে বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায়।

৩. প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের কার্যকারিতা

* প্রশাসনিক কাঠামো: বিভিন্ন বিভাগীয় ফাইল (Departmental Files), অফিসিয়াল চিঠি (Official Correspondence) এবং মিনিট বুক (Minute Books) থেকে বোঝা যায় কীভাবে ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র কাজ করত, কীভাবে উচ্চপদস্থ অফিসাররা সিদ্ধান্ত নিতেন এবং কীভাবে তা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হতো।

* কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্ক: গভর্নর-জেনারেল বা ভাইসরয়ের সঙ্গে প্রাদেশিক গভর্নরদের মধ্যেকার যোগাযোগ বা প্রাদেশিক আইনসভার বিতর্ক (Legislative Debates) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যেকার ক্ষমতা ও সম্পর্কের চিত্র প্রদান করে।

৪. জাতীয় আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি

* সরকারি প্রতিক্রিয়া: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বা অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্থান, তাদের কার্যকলাপ এবং এই আন্দোলনগুলির প্রতি ব্রিটিশ সরকারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, কৌশল ও সিদ্ধান্ত সরকারি নথিতে নথিবদ্ধ থাকত।

* আন্দোলন সংক্রান্ত রিপোর্ট: পুলিশ বা সামরিক বিভাগ কর্তৃক তৈরি করা গোয়েন্দা রিপোর্ট (Intelligence Reports) বা গুপ্ত নথিপত্র থেকে জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের ভিন্ন (সরকারি) দৃষ্টিকোণ জানা যায়।

⚠️ গুরুত্বের সীমাবদ্ধতা (Limitations)
সরকারি নথিপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে:

* একপেশে: এগুলি মূলত ঔপনিবেশিক শাসকদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, যা জনগণের বা নিম্নবর্গের মানুষের মতামত বা অনুভূতিকে উপেক্ষা করে।

* উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: অনেক নথিই সরকারি নীতিকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য অথবা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করার জন্য লেখা হতো, তাই তথ্যগুলি শতভাগ নিরপেক্ষ নাও হতে পারে।

* জনসাধারণের বর্জন: অনেক সংবেদনশীল তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করা হতো।

✨ উপসংহার
ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্র অপরিহার্য, কারণ এগুলি ঔপনিবেশিক প্রশাসনের আইনি ও আনুষ্ঠানিক কার্যধারার নির্ভরযোগ্য সূত্র। আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় এই উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করে অন্যান্য উপাদানের (যেমন—আত্মজীবনী, সংবাদপত্র) সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে তবেই ঔপনিবেশিক ভারতের একটি সম্পূর্ণ ও নিরপেক্ষ চিত্র পাওয়া সম্ভব। এই নথিপত্রগুলি মূলত সরকারি আর্কাইভস (Government Archives)-এ সংরক্ষিত আছে।

এই নথিপত্রগুলি ব্রিটিশ শাসনের কাঠামো ও ক্ষমতা বোঝার জন্য এক অমূল্য ভান্ডার।

—-

মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস: উনিশ শতকের বাংলায় নারী শিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

উনিশ শতকের বাংলায় নারী শিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল যুগান্তকারী ও অপরিহার্য। তিনি শুধুমাত্র একজন পণ্ডিত ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, যিনি মনে করতেন সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য নারীশিক্ষার প্রসার অত্যাবশ্যক। তাঁর এই অবদানকে নিম্নলিখিত প্রধান দিকগুলিতে আলোচনা করা যায়:

১. 🏡 বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ও সম্প্রসারণ

বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন যে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক আলোচনা যথেষ্ট নয়, বরং হাতে-কলমে কাজ করতে হবে।

* বেথুন স্কুল পরিচালনায়: তিনি ডিরেক্টর অফ বেথুন স্কুল (Bethune School)-এর অবৈতনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। এই স্কুলটিকে সমাজের উচ্চবর্গের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেন এবং স্কুলটিকে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন।

* অগণিত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বিদ্যাসাগর ১৮৫০-এর দশকে হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদীয়া সহ বিভিন্ন জেলায় ২৮টিরও বেশি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়গুলিতে প্রায় ১,৩০০ ছাত্রী শিক্ষা গ্রহণ করত।

* সরকারি অনুদান ও রক্ষণাবেক্ষণ: তিনি এই স্কুলগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি অনুদান নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিজের পকেটের টাকা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থও ব্যয় করতেন।

২. 📚 শিক্ষা পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক

নারী শিক্ষার জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রম ও সহজবোধ্য বইয়ের অভাব ছিল।

* সহজ সরল পাঠ্যক্রম: তিনি মেয়েদের জন্য এমন একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করেন যা একদিকে যেমন আধুনিক জ্ঞান দিত, তেমনি অন্যদিকে নারীদের চিরাচরিত সামাজিক অবস্থানের প্রতিও সংবেদনশীল ছিল, যাতে রক্ষণশীল সমাজ সহজে তা মেনে নেয়।

* পাঠ্যপুস্তক রচনা: তিনি মেয়েদের জন্য উপযোগী করে ‘বর্ণপরিচয়’ সহ বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, যা নারী শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সাহায্য করে।

৩. 🤝 রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতা মোকাবিলা

উনবিংশ শতকের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মেয়েদের শিক্ষাকে সন্দেহের চোখে দেখত এবং মনে করত এটি সমাজের অবক্ষয় আনবে।

* জনসাধারণকে বোঝানো: বিদ্যাসাগর অত্যন্ত যুক্তিবাদী এবং সামাজিক কৌশলের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে বোঝান যে মেয়েদের শিক্ষা শুধু তাদের নিজেদের জন্যই নয়, বরং একটি শিক্ষিত প্রজন্ম ও উন্নত পরিবার গঠনের জন্য অপরিহার্য।

* অর্থনৈতিক বাধা দূরীকরণ: দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা যাতে বিদ্যালয়ে আসতে পারে, সেজন্য তিনি অনেক ক্ষেত্রে অবৈতনিক শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেন।

৪. 🎓 শিক্ষিতা নারীর মডেল তৈরি

বিদ্যাসাগর কেবল বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনেই থেমে থাকেননি; তিনি নারী শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে শিক্ষিত নারীর দৃষ্টান্ত স্থাপনে সচেষ্ট হন।

* শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ: নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষিকার অভাব ছিল। বিদ্যাসাগর এই অভাব পূরণের জন্য ব্যবস্থা নেন এবং কিছু শিক্ষিকাকে তৈরি করেন।

* বিধবা বিবাহ: তাঁর উদ্যোগে বিধবা বিবাহ আইন পাস হওয়ায়, সমাজে শিক্ষিত বিধবাদের জন্য শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করার একটি নতুন পথ খুলে যায়, যা নারী শিক্ষার প্রসারে সহায়ক হয়েছিল।

⭐ উপসংহার

নারী শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল বহুমুখী এবং আপসহীন। তিনি শুধুমাত্র তত্ত্বগত সমর্থন দেননি, বরং একাকী হাতে মাঠ পর্যায়ে শত শত বিদ্যালয় স্থাপন করে দেখিয়ে দেন যে শিক্ষা সকলের জন্য, বিশেষ করে নারীর জন্য কতটা প্রয়োজনীয়। তাঁর এই প্রচেষ্টাই পরবর্তীকালে বাংলায় নারী জাগরণের পথ প্রশস্ত করে এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাসে তাঁকে এক শ্রদ্ধেয় স্থানে অধিষ্ঠিত করে।

——

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো। মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস

সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-১৮৫৬), যা হুল (Hul) নামে পরিচিত, ছিল ভারতের উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান। এই বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল ব্রিটিশ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা এবং স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা সাঁওতালদের উপর করা শোষণ ও নিপীড়ন।

১. 🌳 সাঁওতাল বিদ্রোহের (হুল) কারণ

সাঁওতাল বিদ্রোহের একাধিক কারণ ছিল, যা সাঁওতালদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছিল:

ক. অর্থনৈতিক শোষণ

* ভূমি রাজস্বের চাপ: ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সাঁওতালদের আদি বাসস্থান দামিন-ই-কোহ (Damin-i-Koh) অঞ্চলে জমিদারদের আগমন ঘটে। তারা সাঁওতালদের কাছ থেকে অতিরিক্ত হারে খাজনা আদায় করত।

* মহাজনী শোষণ: স্থানীয় মহাজন ও সুদখোর ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের চড়া সুদে ঋণ দিত। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাদের জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া হতো এবং তারা ‘কামিয়া’ (bonded labour) বা ভূমিদাসে পরিণত হতো। সুদ প্রায় ৫০% থেকে ৫০০% পর্যন্ত নেওয়া হতো।

* জোরপূর্বক উচ্ছেদ: নতুন ভূমি বন্দোবস্তের ফলে সাঁওতালদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী জমির উপর থেকে তাদের অধিকার চলে যায়। তাদের নিজেদের হাতে তৈরি করা জমি থেকে তাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়।

খ. প্রশাসনিক ও বিচারিক বঞ্চনা

* আইন ও বিচারের অভাব: সাঁওতালরা তাদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় পুলিশ বা আদালতের দ্বারস্থ হলে তারা বিদেশী কর্মচারী ও স্থানীয় দালালদের পক্ষপাতমূলক আচরণের শিকার হতো। ব্রিটিশ প্রশাসন মহাজন ও জমিদারদের পক্ষ নিত।

* শ্রমিক শোষণ: সাঁওতালদের কম মজুরিতে রেলপথ ও রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতো এবং কাজ শেষে ঠিকমতো মজুরি দেওয়া হতো না।

গ. সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রায় হস্তক্ষেপ

* অরণ্য আইন: ব্রিটিশ সরকার নতুন অরণ্য আইন জারি করে। এই আইনের ফলে সাঁওতালদের চিরাচরিতভাবে অরণ্যের সম্পদ ব্যবহার করা এবং জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে ওঠে।

* বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ: ‘দিকু’ (Diku) নামে পরিচিত বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ সাঁওতালদের সাংস্কৃতিক জীবন ও স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে।

এই শোষণ ও বঞ্চনার ফলস্বরূপ, সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৮৫৫ সালে এই বিদ্রোহ শুরু করে।

২. 🔥 সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল

এই বিদ্রোহ চূড়ান্তভাবে দমন করা হলেও, এর সুদূরপ্রসারী ও গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল:
ক. প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও সাঁওতাল পরগনা গঠন

* পৃথক জেলা: বিদ্রোহের তীব্রতা উপলব্ধি করে ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৫-৫৬ সালে ভাগলপুর ও বীরভূম জেলার কিছু অংশ নিয়ে ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করে।

* স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা: নতুন সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে সাঁওতালদের চিরাচরিত রীতিনীতি অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা (Santhal Pargana Tenancy Act, ১৮৭৬) প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার ফলে কিছু পরিমাণে তাদের অধিকার সুরক্ষিত হয়।

খ. আইনি সুরক্ষা ও শোষণ রোধের উদ্যোগ

* ঋণ সংক্রান্ত আইন: সরকার মহাজনদের শোষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঋণ সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং মহাজনদের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

* ভূমি হস্তান্তর নিষেধাজ্ঞা: আইন করে সাঁওতালদের জমি অ-সাঁওতালদের কাছে হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ করা হয়।

গ. রাজনৈতিক চেতনা ও প্রভাব

* গণ-আন্দোলনের অনুপ্রেরণা: সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতের পরবর্তীকালের কৃষক ও আদিবাসী আন্দোলনগুলিকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে। এটি ছিল ভারতের প্রথম বড় আকারের সশস্ত্র জনবিদ্রোহগুলির মধ্যে একটি, যা ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

* আদিবাসী আত্মসচেতনতা: এই বিদ্রোহ সাঁওতালদের মধ্যে ঐক্য, আত্মমর্যাদা এবং নিজেদের ঐতিহ্যবাহী অধিকার রক্ষার জন্য রাজনৈতিক আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করে।

ঘ. সামরিক দমন

* বিদ্রোহ দমন: বিদ্রোহীরা প্রাথমিকভাবে কিছু সাফল্য পেলেও, ব্রিটিশ সরকার সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। হাজার হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয় এবং সিধু ও কানু সহ অনেক নেতাকে গ্রেফতার ও হত্যা করা হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে ঔপনিবেশিক শোষণ ও নিপীড়ন ভারতীয় আদিবাসী সমাজের উপর কতটা ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছিল এবং একই সাথে এটি আদিবাসীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৃঢ় সংকল্পের এক শক্তিশালী নিদর্শন।

—–

মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস:নীল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব/স্বাতন্ত্র্য ব্যাখ্যা করো।

নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬০) ছিল বাংলার কৃষক সমাজের এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদ, যা নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহ বাংলার কৃষকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনগুলির মধ্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

১. 📜 নীল বিদ্রোহের কারণ

নীল বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল দাদন প্রথা এবং নীলকরদের অমানবিক অত্যাচার, যার ফলে কৃষকরা খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল এবং ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছিল।

ক. জোরপূর্বক নীল চাষ (Compulsory Cultivation)

* দাদন প্রথা: নীলকর সাহেবরা দরিদ্র কৃষকদের দাদন (অগ্রিম ঋণ) গ্রহণে বাধ্য করত। এই ঋণ একবার নিলে চাষিদের আর নীল চাষ না করে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় থাকত না।

* উৎকৃষ্ট জমিতে চাষ: কৃষকদের সেরা জমিতে, যেখানে তারা সাধারণত ধান বা পাট চাষ করত, সেখানে জোর করে নীল চাষ করতে বাধ্য করা হতো। কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীল চাষ করানোই ছিল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ।
খ. ন্যায্য দাম না পাওয়া ও শোষণ

* ক্ষতিপূরণ ও মূল্যহীনতা: কৃষকদের উৎপাদিত নীলের জন্য খুব কম মূল্য দেওয়া হতো, যা চাষের খরচের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না। ফলে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন এবং এই চাষ তাদের জন্য অলাভজনক হয়ে দাঁড়াত।

* চুক্তি লঙ্ঘন: নিরক্ষর কৃষকদের সঙ্গে নীলকররা প্রতারণামূলক চুক্তি করত। একবার দাদন নিলে কৃষকরা বংশানুক্রমে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ত।

গ. নীলকরদের অত্যাচার

* শারীরিক নির্যাতন: নীলকররা অনিচ্ছুক চাষিদের প্রহার করা, আটকে রাখা, সম্পত্তি লুঠ করা এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া সহ নানাভাবে অত্যাচার করত।

* বিচারিক বঞ্চনা: নীলকরদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে কৃষকরা স্থানীয় পুলিশ বা আদালতের দ্বারস্থ হলেও ব্রিটিশ প্রশাসন নীলকরদের পক্ষ নিত, ফলে কৃষকরা সুবিচার পেত না।

২. 💎 নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও স্বাতন্ত্র্য (Importance and Distinctiveness)

নীল বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম সফল কৃষক অভ্যুত্থানগুলির মধ্যে অন্যতম এবং এর কিছু বিশেষ স্বাতন্ত্র্য ছিল:

ক. মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক সমর্থন

* সংবাদপত্রের ভূমিকা: হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মাধ্যমে এই বিদ্রোহের খবর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে পৌঁছায়। এই সমর্থন বিদ্রোহকে জনসমর্থন এবং নৈতিক ভিত্তি প্রদান করে।

* আইনি ও সাহিত্যিক সমর্থন: আইনজীবীরা কৃষকদের পক্ষে আদালতে বিনামূল্যে লড়াই করেন এবং লেখকরা তাদের লেখায় নীলকরদের শোষণ তুলে ধরেন। কোনো কৃষক বিদ্রোহে শিক্ষিত সমাজের এমন প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক সমর্থন আগে দেখা যায়নি।
খ. অহিংস ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ

* সামরিক চরিত্রের অভাব: এই বিদ্রোহ সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহের মতো সামরিক বা রক্তাক্ত চরিত্র ধারণ করেনি। কৃষকরা মূলত একযোগে নীল চাষ বন্ধ করে এবং নীলকরদের কুঠি আক্রমণ করে আইন অমান্যের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটি ছিল একটি সংগঠিত অহিংস প্রতিরোধ।

* হিন্দু-মুসলমান ঐক্য: এই বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমান কৃষকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিল, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে দৃঢ় সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রতীক ছিল।

গ. সরাসরি সাফল্য লাভ

* ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ: বিদ্রোহের তীব্রতা এবং মধ্যবিত্তের সমর্থন সরকারকে বিচলিত করে। ১৮৬০ সালে সরকার নীলচাষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য নীল কমিশন (Indigo Commission) গঠন করতে বাধ্য হয়।

* নীল চাষ বন্ধ: কমিশনের সুপারিশ ও ফলস্বরূপ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নীলচাষ আইনত বন্ধ হয়ে যায়। একটি কৃষক বিদ্রোহের ফলে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের একটি দীর্ঘস্থায়ী নীতি সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হওয়া ছিল এক ঐতিহাসিক সাফল্য।

ঘ. পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক

নীল বিদ্রোহের সাফল্য ভারতের পরবর্তী কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনগুলিকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং দেখিয়েছিল যে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সচেতন পদক্ষেপের মাধ্যমে শোষকদের বিরুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব।
নীল বিদ্রোহ বাংলার কৃষক সমাজের আত্মমর্যাদা এবং সংগঠন শক্তির প্রতীক হিসেবে আজও স্মরণীয়।

—–

মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে কি সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ বলা যায়? অথবা এই বিদ্রোহের চরিত্র আলোচনা করো।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে (The Revolt of 1857) সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ বলা যায় কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে গভীর বিতর্ক রয়েছে। বহু ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে শুধুমাত্র সামন্তশ্রেণির ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখলেও, আধুনিক ঐতিহাসিকরা এর বহুমাত্রিক চরিত্র তুলে ধরেছেন।

১. ❌ কেন এটিকে শুধু সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ বলা যায় না?

ঐতিহাসিকরা এটিকে নিছক সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ বলতে অস্বীকার করেছেন কারণ এর ব্যাপকতা ও অংশগ্রহণের ভিত্তি ছিল অনেক বিস্তৃত।

ক. কৃষক ও সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ

* ব্যাপক গণভিত্তি: বিদ্রোহ কেবল ক্ষমতাচ্যুত জমিদার, তালুকদার বা রাজন্যবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাধারণ কৃষক, কারিগর ও শ্রমিকরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। যেমন – অযোধ্যা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে কৃষকরা জমিদারের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সমর্থন না করে, বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।

* জনসাধারণের উদ্দেশ্য: সাধারণ মানুষের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা (বিশেষত নতুন জমিদারদের শোষণ) এবং অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। এই উদ্দেশ্য সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থের চেয়ে ভিন্ন ছিল।

খ. সিপাহীদের প্রধান ভূমিকা

* সূচনাকারী: বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল প্রধানত সিপাহীদের হাত ধরে, যারা ছিল মূলত কৃষক পরিবারের সন্তান। সিপাহীদের ক্ষোভ ছিল ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত, কম বেতন ও খারাপ চাকরির শর্ত নিয়ে।

* নেতৃত্বের পরিবর্তন: বহু স্থানে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর সিপাহীরা বাধ্য হয়ে পুরনো রাজন্যবর্গকে (যেমন: দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, নানা সাহেব) নেতা হিসেবে মনোনীত করেছিল, কিন্তু প্রাথমিক চালিকা শক্তি তারাই ছিল।

২. ⭐ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রকৃত চরিত্র (বহুমাত্রিকতা)

আধুনিক গবেষণায় বিদ্রোহটিকে একটি জটিল, বহুমাত্রিক এবং মিশ্র চরিত্রযুক্ত আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর চরিত্রকে নিম্নোক্তভাবে বিশ্লেষণ করা যায়:

ক. কৃষক বিদ্রোহের উপাদান

* এলাহাবাদ, অযোধ্যা, বিহার এবং মধ্যভারতের গ্রামগুলিতে কৃষকরা মহাজন ও নতুন জমিদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল সেই সমস্ত শোষক শ্রেণির হাত থেকে ঋণের নথি ও জমির দলিল উদ্ধার করা। এটি ছিল মূলত কৃষক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

খ. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উপাদান

* বিদ্রোহের প্রাথমিক কারণগুলির মধ্যে ছিল এনফিল্ড রাইফেলের টোটায় চর্বি ব্যবহারের গুজব এবং খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের বাড়বাড়ন্ত। এটি ভারতীয় সৈনিক ও সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানায় বিদ্রোহ তীব্র হয়।

গ. সামন্ততান্ত্রিক/রাজকীয় উপাদান

* বিদ্রোহে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈ, নানা সাহেব (কানপুর) এবং তাঁতিয়া টোপির মতো যেসব নেতারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া ক্ষমতা ও রাজ্য পুনরুদ্ধার করা। এই দিকটি নিঃসন্দেহে সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থ প্রতিফলিত করে।

ঘ. জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক রূপ

* যদিও এটি সম্পূর্ণ আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ ছিল না, তবে এটি ছিল প্রথম ব্যাপক ব্রিটিশ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। হিন্দু-মুসলিমের ঐক্য এবং মুঘল সম্রাটকে নেতা হিসেবে বরণ করে নেওয়া এক ধরনের ঐতিহাসিক ঐক্যবোধ সৃষ্টি করেছিল, যা পরবর্তীতে আধুনিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়।

৩. 💡 মূল্যায়ন ও উপসংহার

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে এককভাবে সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ বলা যুক্তিযুক্ত নয়। এই বিদ্রোহ ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রতিরোধ, কৃষক অসন্তোষ, সিপাহী ক্ষোভ এবং ধর্মীয় ভাবাবেগের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ। ঐতিহাসিক ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন একে ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে শুরু হওয়া এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে শেষ হওয়া এক আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সুতরাং, এই বিদ্রোহের চরিত্র ছিল মিশ্র ও জটিল, যেখানে স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং অর্থনৈতিক কারণগুলি একযোগে কাজ করেছিল, যা একে ভারতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ “প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম” (ভি. ডি. সাভারকার-এর মতে) বা “জাতীয় অভ্যুত্থান” (বেঞ্জামিন ডিসরায়েলির মতে) হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

——

কাশ্মীর কীভাবে ভারতে যুক্ত হয়েছিল? মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস

কাশ্মীর ভারতে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল এবং নাটকীয়, যা মূলত ১৯৪৮ সালের উপজাতি আক্রমণের প্রেক্ষিতে বিলয়পত্র (Instrument of Accession) স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

১. 🏔️ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট (১৯৪৭)

* স্বশাসিত রাজ্য: ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়, জম্মু ও কাশ্মীর ছিল একটি বৃহৎ দেশীয় রাজ্য, যার শাসক ছিলেন হিন্দু মহারাজা হরি সিং, এবং জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ছিল মুসলিম।

* স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত: মহারাজা হরি সিং তাৎক্ষণিকভাবে ভারত বা পাকিস্তান কোনোটির সঙ্গেই যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকার (Standstill Agreement) সিদ্ধান্ত নেন। ভারত সরকার এই বিষয়ে তাকে চাপ দেয়নি।

* পাকিস্তান থেকে চাপ: পাকিস্তান কাশ্মীরকে তাদের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য প্রথম থেকেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।

২. ⚔️ উপজাতি আক্রমণ ও সামরিক চাপ

* আক্রমণ শুরু: ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানের মদতপুষ্ট পশতুন উপজাতিরা কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং ব্যাপক লুঠতরাজ শুরু করে। দ্রুত তারা শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

* মহারাজার অসহায়তা: উপজাতিদের এই আক্রমণের মুখে মহারাজা হরি সিংয়ের সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়। তিনি বুঝতে পারেন যে ভারতীয় সামরিক সহায়তা ছাড়া তার রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়।

৩. 📝 বিলয়পত্র স্বাক্ষর (Instrument of Accession)

* ভারতের শর্ত: সামরিক সহায়তা চেয়ে মহারাজা হরি সিং দিল্লিতে আবেদন জানালে, ভারত সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে আইনত বিলয়পত্র স্বাক্ষর না করা পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী অন্য কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারে না।

* স্বাক্ষর: ১৯৪৮ সালের ২৬ অক্টোবর, মহারাজা হরি সিং বিলয়পত্রে (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করেন।

* যুক্ত হওয়ার বিষয়: অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের মতো, এই বিলয়পত্রের মাধ্যমেও কাশ্মীর রাজ্য প্রতিরক্ষা (Defence), পররাষ্ট্র (External Affairs) এবং যোগাযোগ (Communication)—এই তিনটি বিষয় ভারত সরকারের হাতে তুলে দেয়।

* আশ্বাস: ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যের জনমতের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়।

৪. 🇮🇳 ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশ ও জাতিসংঘ

* সামরিক হস্তক্ষেপ: বিলয়পত্র স্বাক্ষরের পরপরই ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর উপত্যকায় প্রবেশ করে এবং উপজাতি আক্রমণকারীদের বিতাড়িত করে।

* জাতিসংঘে আবেদন: ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সরকার কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘে (UNO) আবেদন করে।

* যুদ্ধবিরতি: জাতিসংঘে আলোচনা চলাকালীন, ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি (Ceasefire) কার্যকর হয়। এর ফলে কাশ্মীর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়—যে অংশ ভারতের দখলে ছিল (জম্মু ও কাশ্মীর), এবং যে অংশ পাকিস্তানের দখলে চলে যায় (আজাদ কাশ্মীর)।

৫. 🛡️ বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা

* ধারা ৩৭০: ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধানের ধারা ৩৭০ (Article 370) এর মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়, যার ফলে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজ্যের বিধানসভার অনুমোদন প্রয়োজন হতো। এই বিশেষ মর্যাদা ২০১৯ সালে ভারত সরকার বাতিল করে।

এভাবেই আইনি দলিল (বিলয়পত্র) এবং সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতীয় ইউনিয়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

——

মাধ্যমিক 2026 ইতিহাস: শিক্ষাবিস্তারে/বিজ্ঞান চর্চায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭) ভারতে শিক্ষাবিস্তার এবং বিজ্ঞান চর্চায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম তিনটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম, যা দেশের জ্ঞানচর্চা ও উচ্চশিক্ষার কাঠামো গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছিল।

১. 🎓 শিক্ষাবিস্তারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উনিশ শতক থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত বাংলার এবং বৃহত্তর ভারতের শিক্ষাজগতে নিম্নলিখিত অবদানগুলি রাখে:

ক. উচ্চশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন

* প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো: এই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতে ব্রিটিশ ধাঁচের উচ্চশিক্ষার একটি সুসংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি প্রদান করে। এর আগে কলেজগুলি এককভাবে কাজ করত; বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলিকে পরীক্ষা ও ডিগ্রি প্রদানের একটি অভিন্ন মানদণ্ডের অধীনে আনে।

* জ্ঞানের প্রসার: এটি কলা, বিজ্ঞান, আইন, মেডিসিন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো বিভিন্ন শাখায় ডিগ্রি প্রদানের মাধ্যমে ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান বিস্তারে প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

খ. প্রথম ভারতীয় স্নাতকদের সৃষ্টি

* শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি: এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু ভারতীয় প্রথমবার স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে। এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিই পরবর্তীকালে সরকারি চাকরি, আইন ও সাংবাদিকতার মতো পেশায় প্রবেশ করে এবং বাংলার নবজাগরণ ও জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়।

* নারী শিক্ষায় প্রথম পদক্ষেপ: কাদম্বিনী গাঙ্গুলি এবং চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন, যা ছিল ভারতে নারী শিক্ষার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।

গ. দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ

* স্বীকৃতিদান: এটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কলেজগুলিকে স্বীকৃতি দিত এবং সেগুলির শিক্ষার মান তদারকি করত। এর ফলে শিক্ষার সুযোগ কলকাতার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।

* স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রবর্তন: স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর স্তরে (Post-Graduate Studies) গবেষণাধর্মী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে, যা ভারতের গবেষণার ক্ষেত্রকে মজবুত করে।

২. 🔬 বিজ্ঞান চর্চায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান

বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে বিংশ শতকের প্রথম দিকে:

ক. বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও গবেষণার প্রসার

* বিজ্ঞান বিভাগ চালু: বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়, যা পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যার মতো আধুনিক বিজ্ঞান শাখাগুলিতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার পথ খুলে দেয়।

* ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স (রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ): স্যার আশুতোষ মুখার্জীর উদ্যোগে ১৯১৪ সালে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার এক প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এখানকার গবেষকরা আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের কাজ শুরু করেন।

খ. প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের সৃষ্টি ও পৃষ্ঠপোষকতা

* প্রতিভাধর বিজ্ঞানী: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতে স্যার আশুতোষ মুখার্জী, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, স্যার সি. ভি. রমন এবং ড. মেঘনাদ সাহার মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের সৃষ্টি ও লালন-পালন করেছে।

* রাসায়নিক গবেষণায় অবদান: আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রসায়ন গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে শিল্প-বাণিজ্যের সংযোগ স্থাপন করে।

গ. জ্ঞান ও অর্থের সংস্থান

* টেগর প্রফেসorship ও অন্যান্য পদ: বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য বিভিন্ন অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয় এবং প্রখ্যাত ভারতীয়দের নামাঙ্কিত ফেলোশিপ চালু করা হয়।

* আর্থিক সহায়তা: গবেষণা এবং ল্যাবরেটরি স্থাপনের জন্য আশুতোষ মুখার্জী বিভিন্ন ব্যক্তিগত অনুদান (যেমন তারকনাথ পালিত এবং রাসবিহারী ঘোষের অনুদান) সংগ্রহ করেন, যা বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তিকে মজবুত করে।

✨ উপসংহার

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, এটি ছিল ভারতীয় নবজাগরণের কেন্দ্রস্থল। শিক্ষাবিস্তার ও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এর অবদানগুলি ভারতকে আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করতে এবং জাতীয় চেতনার বিকাশে এক মৌলিক ভূমিকা পালন করেছিল।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *