পৃথিবীর আহ্নিক গতি পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলাফল|ফেরেলের সূত্র|

 পৃথিবীর আহ্নিক গতি| পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলাফল|ফেরেলের সূত্র|

পৃথিবীর-আহ্নিক-গতি-পৃথিবীর-আহ্নিক-গতির-ফলাফল-ফেরেলের-সূত্র

পৃথিবীর আহ্নিক গতি

◆ পৃথিবীর আহ্নিক গতির সপক্ষে প্রমাণগুলি লেখাে। অথবা, পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে’ কীভাবে প্রমাণ করবে?

 পৃথিবীর আহ্নিক গতির সপক্ষে প্রমাণসমূহ

 

পৃথিবীর আহ্নিক গতি: যে গতির দ্বারা পৃথিবী নিজ অক্ষ বা মেরুদণ্ডের ওপর পশ্চিম থেকে পূর্বে (ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে) 23 ঘণ্টা 56 মিনিট 4 সেকেন্ডে বা প্রায় 24 ঘণ্টায় একবার আবর্তন করে, সেই গতিকেই আবর্তন বা আহ্নিক গতি (Rotational movement) বলা হয়।

 

পৃথিবীর যে আহ্নিক গতি আছে তা বিভিন্নভাবে প্রমাণ করা যায়, যেমন

 

1. দিন ও রাতের পর্যায়ক্রমিক সংঘটন; আবর্তন গতি আছে বলেই মােটামুটি প্রতি 24 ঘণ্টায় পৃথিবীর যে-কোনাে স্থান পর্যায়ক্রমে একবার সূর্যের সামনে আসে, ফলে সেইস্থানে দিন হয়। যদি পৃথিবীর আবর্তন গতি না থাকত, তাহলে পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের সামনে থাকত সেখানেই সবসময়ে দিন ও বিপরীত অংশে সবসময় রাত বা চির-অন্ধকার বিরাজ করত।

 

2. পৃথিবীর অভিগত গােলকাকৃতি: কোনাে নমনীয় বস্তু তার অক্ষরেখার চারিদিকে অনবরত আবর্তন করলে মাঝখানে সবচেয়ে বেশি কেন্দ্ৰবহির্মুখী শক্তির উদ্ভব হয় এবং এর ফলে বস্তুর মধ্যভাগ কিছুটা স্ফীত হয় এবং প্রান্তদ্বয় কিছুটা চাপা হয়ে যায়। পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্যই নমনীয় অবস্থা থেকে কঠিন অবস্থায় পৌছােনাের সময় নিরক্ষীয় অঞ্চল কিছুটা স্ফীত ও মেরুদ্বয় চাপা হয়েছে। অর্থাৎ আবর্তন গতির জন্যই পৃথিবীর আকৃতি হয়েছে অভিগত গােলকাকার।

 

3. খুব উঁচু থান থেকে পতনশীল প্রস্তরখণ্ডের আপাত সঞ্চলন: খুব উঁচু স্থান থেকে একটি প্রস্তরখণ্ড নিশ্চল বায়ুর মধ্য দিয়ে নীচে ফেলে দিলে দেখা যায় পাথরটি সােজাসুজি না পড়ে একটু পূর্বদিকে এগিয়ে গিয়ে পড়ে। পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্যেই এই ঘটনা ঘটে।

 

4. কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তােলা ছবি: মহাকাশে পাঠানাে বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে যে ছবি তােলা হয়েছে তা থেকে পৃথিবীর আবর্তন গতির নির্ভুল ও সর্বাধুনিক প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

5. অন্যান্য গ্রহের আবর্তন গতি: সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, যেমনবুধ, শুক্র প্রভৃতি নিজের মেরুদণ্ডের চারদিকে আবর্তন করে চলেছে। পৃথিবী যেহেতু একটি গ্রহ, তাই সেও সূর্যকে কেন্দ্র করে নিজ অক্ষের চারদিকে আবর্তন করছে বলা যায়।

 

6. ফুকোর পরীক্ষা: ফরাসি বিজ্ঞানী ফুকো (1851 সাল) দোলকের পরীক্ষার সাহায্যেও প্রমাণ করেন যে, পৃথিবীর আবর্তন গতি রয়েছে।

 

◆ পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলাফল আলােচনা করাে। অথবা, পৃথিবীর যে-কোনাে একটি গতির ফলাফল বর্ণনা করাে। 

 

পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলাফল

 

যে গতির দ্বারা পৃথিবী নিজের অক্ষ বা মেরুদণ্ডের ওপর পশ্চিম থেকে পূর্বে (ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে) 23 ঘণ্টা 56 মিনিট 4 সেকেন্ডে বা প্রায় 24 ঘণ্টায় একবার আবর্তন করে, সেই গতিকেই আবর্তন বা আহ্নিক গতি বলা হয়। পৃথিবীর আবর্তনগতির ফলাফলগুলি হল

 

1. পর্যায়ক্রমে দিন ও রাত সংঘটন:

পৃথিবীর নিজস্ব কোনাে আলাে নেই। সূর্যের আলােতেই পৃথিবী আলােকিত এবং উত্তপ্ত হয়। তাই আবর্তন করার সময় পর্যায়ক্রমে গােলাকার পৃথিবীর যে অংশে সূর্যের আলাে পড়ে, সেখানে হয় দিন। বিপরীত অংশে সূর্যের আলাে পড়ে না, ফলে সেখানে হয় রাত।

 

2. সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত: পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে আবর্তন করে বলেই প্রতিদিন পূর্বদিকে সূর্যোদয় এবং পশ্চিমদিকে সূর্যাস্ত হয়। 3. সময় নির্ধারণ: নিজ অক্ষের ওপর একবার সম্পূর্ণভাবে আবর্তন করতে পৃথিবীর সময় লাগে প্রায় 24 ঘণ্টা বা 1 দিন। আবর্তনের এই সময়কে 24 ভাগ করে প্রতিটি ভাগকে 1 ঘণ্টা ধরা হয়। এরপর এই 1 ঘণ্টাকে সমান 60টি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগকে 1 মিনিট এবং এই 1 মিনিটকে সমান 60 ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগকে 1 সেকেন্ড ধরে সহজে সময় নির্ধারণ করা যায়।

 

4. নিয়ত বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রস্রোতের দিবিক্ষেপ: পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য যে কেন্দ্ৰবহির্মুখী বলের সৃষ্টি হয় সেই বলকে কোরিওলিস বল বলে। এই বলের প্রভাবে সমুদ্রস্রোত ও নিয়ত বায়ুপ্রবাহের দিবিক্ষেপ ঘটে। অর্থাৎ পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্যই নিয়ত বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতি উত্তর গােলার্ধে ডানদিকে এবং দক্ষিণ গােলার্ধে বামদিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়।

 

5. জোয়ারভাটা সৃষ্টি: মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম অনুসারে চাঁদ ও সূর্য উভয়ই পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। কিন্তু সূর্যের তুলনায় চাঁদ পৃথিবীর নিকটবর্তী বলে পৃথিবীর ওপর চাঁদের আকর্ষণের প্রভাব অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। আবর্তনের সময় পৃথিবীর যে স্থান চাঁদের সামনে আসে সেই স্থানের জলরাশি ফুলে ওঠে অর্থাৎ সেই স্থানে মুখ্য জোয়ার হয়। একই সময় ঠিক এর বিপরীত দিকে, পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উৎপন্ন কেন্দ্ৰবহির্মুখী শক্তির প্রভাবে গৌণ জোয়ার হয় এবং এর সমকোণে অবস্থিত স্থানগুলিতে তখন ভাটা হয়।

 

6. উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ সৃষ্টি: আবর্তন গতি না থাকলে পৃথিবীর নির্দিষ্ট একটি অর্ধাংশে চিরকাল রাত থাকত, ফলে আলাে ও উত্তাপের অভাবে কোনাে জীবই জন্মাতে পারত না। আর, অপর অর্ধাংশে চিরকাল দিন থাকত ফলে প্রচণ্ড উত্তাপে সেখানেও কোনাে জীবের জন্ম হত না। কিন্তু পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পর্যায়ক্রমে দিন ও রাত হয়। তাই পৃথিবীতে উত্তাপের সমতা বজায় রয়েছে এবং পৃথিবীতে উদ্ভিদ প্রাণীজগতের সৃষ্টি হয়েছে।

  1. ■ পৃথিবীতে দিন ও রাত হয় কীভাবে? দিন ও রাতের বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনা করাে। 2+3

 

দিন ও রাতের সংযটন

 

পৃথিবী নিজ অক্ষের চারিদিকে পশ্চিম থেকে পুর্বে আবর্তন করে চলেছে। পৃথিবীর এই আবর্তন গতির জন্য ভূপৃষ্ঠে পর্যায়ক্রমে দিনরাত্রি সংঘটিত হচ্ছে। গােলাকার পৃথিবী সূর্যের আলােতেই আলােকিত হয়। আবর্তনের সময় পৃথিবীর যে অর্ধাংশ সূর্যের দিকে থাকে সেখানে সূর্যের আলাে পড়ে, ফলে সেখানে হয় দিন। আবার বিপরীত দিকের অর্ধাংশে সূর্যের আলাে পড়ে না, ফলে সেখানে হয় রাত।

 

দিন ও রাতের বিভিন্ন অবস্থা

 

পৃথিবী গােলাকার বলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় ভূপৃষ্ঠে দিন ও রাতের বিভিন্ন অবস্থা, যেমন—0 উষা ও গােধূলি, @ প্রভাত ও সন্ধ্যা, ও মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাত প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।

 

1. উষা ও গােধূলি: প্রভাতে সূর্যোদয়ের কিছু আগে যে সময়টিতে পৃথিবীর অন্ধকার অংশ ছায়াবৃত্ত পেরিয়ে আলােকিত অংশে প্রবেশ করে, ঠিক সেই মূহূর্তে সেইস্থানে বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণায় সূর্যের আলাে প্রতিফলিত হয়ে পূর্ব আকাশে ক্ষীণ আলাে দেখতে পাওয়া যায়, সেই সময়টিকে বলে উষা। আবার সূর্যাস্তের পর যে সময়টিতে পৃথিবীর আলােকিত অংশ ছায়াবৃত্ত পেরিয়ে অন্ধকার অংশে প্রবেশ করে, সেই মূহূর্তে বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণায় সূর্যের আলাে প্রতিফলিত হয়ে পশ্চিম আকাশে ক্ষীণ আলাে দেখতে পাওয়া যায়, সেই সময়টিকে বলে গােধূলি।

 

2. প্রভাত ও সন্ধ্যা: আবর্তনের জন্য ভূপৃষ্ঠের কোনাে স্থান যখন অন্ধকার থেকে ছায়াবৃত্ত পেরিয়ে আলােকিত হয় তখন সেখানে প্রভাত বা সকাল হয়। এর ঠিক বিপরীত দিকে থানটি তখন। ছায়াবৃত্ত পেরিয়ে অন্ধকার অংশে প্রবেশ করে, ফলে সেখানে হয়। সন্ধ্যা।

3. মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাত: পৃথিবীর আলােকিত অর্ধাংশের একেবারে মাঝখানের স্থানটিতে সূর্য অবস্থান করলে সেখানে হয় মধ্যাহ্ন। মধ্যাহ্নের ঠিক বিপরীত দিকে অন্ধকার অর্ধাংশের মধ্যবর্তী থানটিতে সেই সময় হয় মধ্যরাত।

 

●পৃথিবীর সর্বত্র আবর্তন বেগ সমান নয় কেন?

 

• পৃথিবীর সর্বত্র আবর্তনের বেগ সমান না হওয়ার কারণ : 

 পৃথিবী 23 ঘণ্টা 56 মিনিট 4 সেকেন্ডে নিজ অক্ষের ওপর একবার আবর্তন করে। বিভিন্ন অক্ষরেখায় পৃথিবীর পরিধি বিভিন্ন হওয়ার কারণে বিভিন্ন অক্ষরেখায় পৃথিবীর আবর্তন বেগের তারতম্য হয়। নিরক্ষরেখা বরাবার পৃথিবীর পরিধি সবচেয়ে বড়াে, তাই নিরক্ষরেখা বরাবর পৃথিবীর আবর্তন বেগও সর্বাধিক। নিরক্ষরেখায় পৃথিবীর আবর্তন বেগ ঘণ্টায় 1675 কিমি। নিরক্ষরেখা থেকে মেরুর দিকে যত যাওয়া যায় ততই

 

পৃথিবীর পরিধি ক্রমশ ছােটো হতে হতে মেরুতে শূন্য হয়। তাই নিরক্ষরেখা থেকে মেরুর দিকে পৃথিবীর আবর্তন বেগ কমতে কমতে শেষে দুই মেরুতে তা আর পরিলক্ষিত হয় না।

আমরা পৃথিবীর আবর্তন গতি বুঝতে পারি না কারণ ব্যাখ্যা করাে। 

 

– । পৃথিবীর আবর্তন গতি বুঝতে না পারার কারণ : আমরা পৃথিবীর আবর্তন গতি বুঝতে পারি না, তার কারণ হল—

 

1 মানুষ ও পরিপার্শ্বিক পরিবেশের একইসঙ্গে আবর্তন: আমরা যেখানে বসবাস করি তার চারপাশের গাছপালা, বাড়িঘর, মাঠঘাট সবকিছুই আমাদের সঙ্গে একইভাবে আবর্তন করে চলেছে। তাই পৃথিবীর আবর্তন গতি আমাদের পক্ষে বােঝা সম্ভব নয়। আমাদের পৃথিবীকে স্থির বলে মনে হয়।

 

2 অভিকর্ষজ বল: পৃথিবী নিজের মাধ্যাকর্ষণ বলের দ্বারা আমাদের ও ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য বস্তুকে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে। ফলে, আমরা পৃথিবীর গায়ের সঙ্গে লেগে থাকি ও এত প্রবল গতিতে পৃথিবীর আবর্তন সত্ত্বেও ছিটকে পড়ি না।

 

3 ক্ষুদ্র আকার: পৃথিবীর আয়তনের তুলনায় আমরা এতই ক্ষুদ্র যে আমাদের পক্ষে পৃথিবীর আবর্তন গতি বােঝা সম্ভব নয়।

 

● আবর্তন গতি না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ হত না”—এই বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দেখাও।

 

পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশে আবর্তন গতির প্রভাব: “আবর্তন গতি না । থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ হতনা,এই বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি

 

1 উন্নতার সমতা বজায় : পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য ভূপৃষ্ঠে পর্যায়ক্রমে দিন ও রাত্রি সংঘটিত হয়। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে উয়তার সমতা বজায় থাকে। এই কারণেই পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ সৃষ্টির উপযােগী পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

 

 2 পৃথিবীর আবর্তন গতি: পৃথিবীর আবর্তন গতি না থাকলে পৃথিবীর যে অংশ চিরকাল সূর্যের দিকে অবস্থান করত, সেই অংশে প্রখর উত্তাপে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যেত এবং এর বিপরীত অংশ আলাে ও উত্তাপের অভাবে প্রবল শীতল হত ও চিরতুষারে ঢাকা থাকত। ফলে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ হত না, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের কোনাে অস্তিত্বই থাকত না।

 

● ফেরেলের সূত্রটি লেখাে। 

 ফেরেলের সূত্র : পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে সৃষ্ট কোরিওলিস বলের ওপর ভিত্তি করে 1855 সালে মার্কিন বিজ্ঞানী ফেরেল একটি সূত্র। প্রদান করেন। এই সূত্রানুসারে ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনাে গতিশীল পদার্থ, যেমন বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতি উত্তর থেকে দক্ষিণে বা দক্ষিণ থেকে উত্তরে সােজাসুজি প্রবাহিত না হয়ে উত্তর গােলার্ধে ডানদিকে এবং দক্ষিণ গােলার্ধে বামদিকে সামান্য বেঁকে যায়।। এটি ‘ফেরেলের সূত্র’ নামে পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *