দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ফলাফল ভয়াবহতা ব্যাপকতা|World War II

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ, ফলাফল, ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা|World War II 

 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন কারণ আলােচনা করাে।

 

• উত্তর

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে একদিকে ছিল অক্ষশক্তিভুক্ত জার্মানি, ইটালি, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্র এবং অন্যদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি রাষ্ট্র। 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন কারণ

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পশ্চাতে বিভিন্ন কারণ ছিল।

 

১)  ত্রুটিপূর্ণ ভার্সাই সন্ধি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মানির ওপর তীব্র বৈষম্যমূলক ভার্সাই সন্ধি (১৯১৯ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। এর দ্বারা i] জার্মানির বিভিন্ন ভূখণ্ড, শিল্পাঞ্চল, খনি ও উপনিবেশগুলি কেড়ে নেওয়া হয়, [ii] জার্মানির সামরিক শক্তি হ্রাস করে তাকে ক্ষুদ্র বেলজিয়ামের চেয়েও দুর্বল করা হয়, [ii] জার্মানির ওপর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণের বােঝা চাপানাে হয়। জার্মানি এই ‘একতরফা চুক্তি’ ভেঙে ফেলার সুযােগের অপেক্ষায় ছিল।

দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধের-কারণ-ফলাফল-ভয়াবহতা-ব্যাপকতা-World-War-II

 

২)  ঔপনিবেশিক লড়াই: বিংশ শতকের শুরুতে বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের দখলে চলে যায়। পরবর্তীকালে ইটালি, জাপান প্রভৃতি দেশ খুব বেশি উপনিবেশ দখল করার সুযােগ না পেয়ে ক্ষুদ্ধ হয়। তাছাড়া ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানির অধিকাংশ উপনিবেশ মিত্রপক্ষ কেড়ে নেয়। ফলে উপনিবেশের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। .

 

৩) একনায়কতন্ত্রের উত্থান : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েকটি দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসকের উদ্ভব ঘটে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইটালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসােলিনি, জার্মানির নাৎসি শাসক হিটলার, জাপানের শাসক তােজো প্রমুখ। তাদের উগ্র সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদী নীতি বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টি করে।

৪) নিরীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা : জেনেভার নিরস্ত্রীকরণ | সম্মেলনে (১৯৩৩ খ্রি.) বৃহৎ শক্তিগুলি জার্মানির অস্ত্রশক্তি হ্রাসে | অত্যন্ত উদগ্রীব হলেও তারা নিজেদের অস্ত্রশক্তি হ্রাস করতে রাজি |ছিল না। জার্মানি নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সুযােগ না পেয়ে সম্মেলন ত্যাগ করে নিজের ইচ্ছামতাে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে।

 

 ৫) জাতিসংঘের ব্যর্থতা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠ লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতিসংঘ তার লক্ষ্যপূরণে বারবার ব্যর্থ হয়। যেমন—i] জাপান চিনের মারিয়া (১৯৩১ খ্রি.) করলেও জাতিসংঘ জাপানের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নিতে পারেনি, [ii] ইটালি অ্যাবিসিনিয়া দখল (১৯৩ খ্রি.) করলে জাতিসংঘ তা প্রতিরােধ করতে ব্যর্থ হয়, [ii] জার্মানি জাতিসংঘ ত্যাগ করার পর একে একে রাইন ভূখণ্ড, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া প্রভৃতি দখল করে। কিন্তু এই রকম পরিস্থিতিতেও জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। [6] শক্তিজোট : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্ব পরস্পর-বিরােধী দুটি সশস্ত্র শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে থাকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি দেশকে নিয়ে গড়ে ওঠা মিত্রশক্তি এবং অন্যদিকে থাকে জার্মানি, ইটালি, জাপান প্রভৃতি দেশকে নিয়ে গড়ে ওঠা অক্ষশক্তি। উভয় শিবিরের মধ্যে সমরসজ্জার প্রতিযােগিতা শুরু হয়।

 

৭) ইঙ্গ-ফরাসি তােষণ : জার্মানি, ইটালি, জাপান প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ক্রমাগত ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন ধারাগুলি লংঘন করে বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালায়। এই আগ্রাসন প্রতিরােধের চেষ্টা না করে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে তােষণ করতে থাকে। ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি মনে করত যে, তােষণনীতির মাধ্যমে যুদ্ধ এড়ানাে যাবে। কিন্তু এই তােষণনীতির ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির আগ্রাসন আরও বেড়ে যায়।

 

৮)  প্রত্যক্ষ কারণ : জার্মানির শাসক হিটলার ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর পােল্যান্ড আক্রমণ করলে ৩ সেপ্টেম্বর ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। 

মূল্যায়ন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত যুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি পরাজিত হয়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর ইটালি, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে জার্মানি এবং ২ সেপ্টেম্বর জাপান আত্মসমর্পণ করে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। 

 

 * দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল/প্রভাব সম্পর্কে আলােচনাকরাে। 

 

উত্তর

 

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯s৫ খ্রি.)। জার্মানি, ইটালি, জাপান ও তাদের সহযােগী বিভিন্ন দেশকে নিয়ে গঠিত অক্ষশক্তি এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা ও তাদের সহযােগী বিভিন্ন দেশকে নিয়ে গঠিত মিত্রশক্তির মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল / প্রভাব

 

বিভিন্ন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যেমন—

 

১) ধ্বংসলীলা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের প্রচুর সামরিক ও অসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়। অন্তত ৫.৭ কোটি মানুষ এই যুদ্ধের ফলে প্রাণ হারান। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে নিঃস্ব, রিক্ত অবস্থায় নতুন দেশের ফুটপাতে আশ্রয় নেয়।

 

২) যুদ্ধাপরাধের বিচার : বিজয়ী মিত্রপক্ষ পরাজিত অক্ষশক্তির যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তিদানের উদ্যোগ নেয়।২১ জন নাৎসি আধিকারিককে শান্তি-বিরােধী, মানবতা-বিরােধী যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের ১৪ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং বাকিদের কারাদণ্ড হয়।

 

 [3] ইয়াল্টা সম্মেলন : ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে জার্মানির পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে পড়লে মিত্রপক্ষের আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও রাশিয়া ইয়ান্টা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির দ্বারা—i] বিশ্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা, [ii] জার্মানি নাৎসি প্রভাবের অবসান ঘটানাে, (iii) জার্মান যুদ্ধাপরাধী শাস্তিদান, [iv] জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

 

৪) অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন : যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির  অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্ব আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে জাতিপুঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন’ বা ‘আনরা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। আনরার সাহায্যের ফলে যুদ্ধ-বিধস্ত বিভিন্ন দেশের বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন, কৃষি ও পুনরুজ্জীবন, পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি সম্ভব হয়।

 

৫)  টুম্যান নীতি গ্রিস, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ থেকে ব্রিটেন সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা ঘােষণা করলে আমেরিকা আশঙ্কা করে যে, সেসব দেশে কমিউনিস্ট রাশিয়ার আধিপত্য বাড়বে ।এই অবস্থায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে ট্রুম্যান নীতি। ঘােষণা করেন (১২ মার্চ, ১৯৪৭ খ্রি.)। এই নীতি অনুসারে প্রস। ও তুরস্কে ৪০ কোটি ডলার সাহায্য দেওয়া হয়।

 

৬) মার্শাল পরিকল্পনা : মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জর্জ সি ইউরােপীয় পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা’ (European Recovery Programme’বা ERP’)নামে এক পরিকল্পনা ঘােষণা করেন। সাধারণভাবে মার্শাল পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনাঃ জন্য আমেরিকা চার বছরের জন্য (১৯৪৮-৫১ খ্রি.) ইউরােপের আর্থিক পুনরুজ্জীবন খাতে ১২০০ ডলার অর্থ মঞ্জুর করে।

 

৭)  আমেরিকার আধিপত্য : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র আমেরিকা সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে যুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এবং বিশ্বরাজনীতিতে সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করে। 

 

৮) জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি : বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এশিয়া মহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, বার্মা, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচিন এবং আফ্রিকা মহাদেশের মিশর, সুদানসহ বিভিন্ন উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

 

মূল্যায়ন: যুদ্ধশেষে আমেরিকার নেতৃত্বে তার অনুগামীদের নিয়ে উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা বা ন্যাটো’ (NATO) (১৯৪৯ খ্রি.) নামে জে গড়ে ওঠে। এর বিরুদ্ধে সােভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে তার অনুগাম রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে ওয়ারশ চুক্তি’ (১৯৫৫ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। প্রকাশ্য যুব না হলেও উভয় পক্ষের মধ্যে সর্বদা একটি যুদ্ধের পরিবেশ বজায় থাকে এই ঘটনা ঠান্ডা লড়াই’ নামে পরিচিত।

 

 

■ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা উল্লেখ করাে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বােমাবর্ষণ সম্পর্কে আলােচনা করাে।

 

 উত্তর

 

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শেষ হয়। 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা

 

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে মানব সভ্যতার ওপর ধ্বংসলীলা চলে।

 

 ১] ভয়ংকরতম যুদ্ধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবী জুড়ে মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের কোনাে সুনির্দিষ্ট সরকারি হিসাব পাওয়া না গেলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই যুদ্ধ হল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ।

 

২) প্রাণহানি : বিভিন্ন সূত্র থেকে এই ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। মােটামুটিভাবে বলা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অন্তত, ৫.৭ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। আনুমানিক ৭৫ লক্ষ রুশ, ৩৫ লক্ষ জার্মান, ২২ লক্ষ চিনা, ১২ লক্ষ জাপানি যুদ্ধের ফলে প্রাণ হারান। কোরিয়া, ইটালি, কানাডা, গ্রিস, বেলজিয়াম, রােমেনিয়া, বালগেরিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশের প্রচুর মানুষও যুদ্ধে মারা যায়। 

 

৩) ধ্বংসলীলা : যুদ্ধের ফলে বিপুল সংখ্যক অসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়। মানুষের জীবনহানি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের বহু শহর ও শিল্পাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হাজার হাজার ঘরবাড়ি

ও রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যায়। জার্মান আক্রমণে লেনিনগ্র্যাড, স্ট্যালিনগ্রাড-সহ রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। মানুষ ও সম্পদহানির নিরিখে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাশিয়া।

 

৪)  পারমাণবিক বােমার ব্যবহার : পারমাণবিক বােমাবর্ষণের ফলে জাপানের হিরােশিমা শহরে ৭৮ হাজার ও নাগাসাকি শহরে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। এই দুই শহরের রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংসস্কৃপে পরিণত হয়। জাপানের সর্ববৃহৎ ৬০টি শহরের অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।

 

৫) আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতি : আমেরিকা যুদ্ধের প্রথমদিকে অংশ না নেওয়ায় এবং আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে অক্ষশক্তি প্রত্যক্ষ আক্রমণে ব্যর্থ হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম। অবশ্য এই কম পরিমাণটিও ছিল যথেষ্ট আতঙ্কের। যুদ্ধে আমেরিকার ৪ লক্ষাধিক মানুষ নিহত এবং ৬ লক্ষাধিক মানুষ আহত হন।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে পারমাণবিক বােমাবর্ষণ

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা হল জাপানের হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বােমাবর্ষণ।

 

১) পোসডাম সম্মেলন : মিত্রশক্তির কাছে। জার্মানির আত্মসমর্পণের (৭ মে, ১৯৪৫ খ্রি.) পর মিত্রশক্তির নেতারা ১৭ জুলাই জার্মানির পােসডাম শহরে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে জাপানের আত্মসমর্পণের দাবি জানায়। জাপান এই দাবি উপেক্ষা করলে আমেরিকা জাপানের হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বােমা বর্ষণ করে। 

২) হিরোশিমায় বোমাবর্ষণ:  আমেরিকা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট সকাল ৮ টা ১৫ মিনিটে জাপানের শিল্প শহর হিরােশিমায় লিটল বয়’ নামে প্রথম পারমাণবিক বােমা বর্ষণ করলে শহরটি কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় এবং এর ফলে প্রায় ৭৮ হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়।

 

৩) নাগাসাকিতে বােমাবর্ষণ : আমেরিকা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট রাত ৩ টে ৪৭ মিনিটে জাপানের নাগাসাকিতে ফ্যাট ম্যান’ নামে দ্বিতীয় পারমাণবিক বােমা বর্ষণ করলে শহরটি কার্যত ধ্বংসস্তৃপে পরিণত হয় এবং এর ফলে প্রায় ৪০ হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়।

 

৪) জাপানের আত্মসমর্পণ : পারমাণবিক বােমাবর্ষণের ফলে হিরােশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংসস্কৃপে পরিণত হলে জাপানের মনােবল ভেঙে যায়। শেষপর্যন্ত জাপান ২ সেপ্টেম্বর (১৯৪৫ খ্রি.) আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে।

 

* দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তারের ব্যাপকতা উল্লেখ করাে। অথবা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বজনীনতার পরিচয় দাও।

 

উত্তর

 

ইউরােপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দীর্ঘ ৬ বছর (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ খ্রি.২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ খ্রি.) ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লড়াই চলে।

 

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতা/বিশ্বজনীনতা

 

বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই সবচেয়ে বেশি ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বজনীন রূপ লাভ করে।

 

১) ব্যাপকতা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশ অংশ নেয়। স্থল, জল ও অন্তরীক্ষের সর্বত্র এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ইউরােপ, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে বিভিন্ন নৌযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।

 

২) জার্মানির লড়াই: যুদ্ধের শুরুতে জার্মানি ও রাশিয়া পােল্যান্ড দখল করে নেয়। ইউরােপের বাল্টিক অঞ্চল, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি অঞলে ব্যাপক জার্মান আক্রমণ চলে। পরে জার্মানি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া আক্রমণ করলে সেখানে যুদ্ধ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। 

 

3)  ইটালির লড়াই: অক্ষশক্তিভুক্ত ইটালি উত্তর আফ্রিকায় আক্রমণ চালায়। আফ্রিকায় কয়েকটি নৌযুদ্ধ মারাত্মক হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত ইটালি সেখানে ইংল্যান্ডের হাতে পর্যুদস্ত হয়।

 

৪) জাপানের অগ্রগতি : যুদ্ধের প্রথম থেকে জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন দ্বীপ, ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, মালয়, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড দখল করে নেয়।

 

৫) আমেরিকার যােগদান : জাপান ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে বােমা বর্ষণ করে। ফলে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে মিত্রপক্ষের সমর্থনে যুদ্ধে যােগদান করে ও আমেরিকায় বিশ্বযুদ্ধ বিস্তৃত হয়।

 

৬) এশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী লড়াই: জার্মানির পতনের (৭ মে, ১৯৪৫ খ্রি.) পর ইউরােপে যুদ্ধ শেষ হলেও এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞলে জাপান ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ আরও কিছুদিন চলে। শেষপর্যন্ত জাপানে পারমাণবিক বােমাবর্ষণের ফলে জাপান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।

 

উপসংহার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দীর্ঘ ৬ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞলে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই যুদ্ধ প্রকৃতই বিশ্বজনীন চরিত্র লাভ করে। ফলে এই যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব থেকে কোনাে দেশই রক্ষা পায়নি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *