সাম্প্রদায়িকতা কি ? সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ Teacj Sanjib
সাম্প্রদায়িকতা কি ? সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ Teacj Sanjib
প্রশ্ন সাম্প্রদায়িকতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর। যে সকল সামাজিক ব্যাধি একটি জাতির দেহে দুষ্ট ক্ষতের সৃষ্টি করে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল সাম্প্রদায়িকতা। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকার সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাটি ভারতের রাজনীতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর বহু দেশই এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষে আক্রান্ত।
এখন প্রশ্ন হল সাম্প্রদায়িকতা বলতে কী বােঝায়। সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িকতা বলতে কোন ধর্মমতের প্রতি গভীর প্রত্যয় বা ভালবাসার সম্পর্ককে বােঝায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্মমতের প্রতি বিশ্বাস বা অনুরাগকে সাম্প্রদায়িকতা বলা যায় না। বাস্তবে সাম্প্রদায়িকতা বলতে বােঝায় এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ ও প্ররােচনাদানমূলক কাজ। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় কর্তৃক অন্য একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ভাব পােষণ এবং তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানােই হল সাম্প্রদায়িকতা। ভি. আর. মেহেতা (V. R. Mehta) তার “Ideology, Modernisation and Politics in India গ্রন্থে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিরােধকে সাম্প্রদায়িকতা বলে উল্লেখ করেছেন। রবার্ট মেলসন এবং উলপে (Melson and Wolpe) বলেছেন, কোন সম্প্রদায়ের নিজ অস্তিত্বকে রাজনৈতিকভাবে জাহির করাই হল সাম্প্রদায়িকতা।
সাম্প্রদায়িকতা হল একটা মতাদর্শ যা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে নিজের ধর্মীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সাম্প্রদায়িকতার ধরন হল অন্তর্নিহিত শত্রুতা, যার ভিত্তি হল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্যহীন স্বার্থের সংঘাত। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র তার Communalism in Modern India গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, সাম্প্রদায়িকতা হল এমন এক বিশ্বাস যে একটি বিশেষ ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট ধর্মভুক্ত মানুষদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
শ্রী সুধাংশু দাসগুপ্ত একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন যে সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা খুব পরিষ্কার। সাম্প্রদায়িকতা মানে হল ধর্ম ও রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলা, শিক্ষা, প্রশাসন রাজনীতিতে কোন একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চিন্তাধারাকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সেই ধর্মীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করা। রাজনীতিতে, প্রশাসন ব্যবস্থায় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মের হস্তক্ষেপই সাম্প্রদায়িকতা।
শ্ৰী দাসগুপ্ত আরও বলেন, সংক্ষেপে ধর্মনিরপেক্ষতা হল ধর্ম থেকে রাজনীতি ও শিক্ষার সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতার মানে হল ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় কার্যকলাপের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ গঠন করা। ধর্মের ভিত্তিতে কিংবা ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুনাফা লাভের জন্য যেসব দল গড়ে ওঠে সেগুলিকে সাম্প্রদায়িক দল বলা হয়। ভারতীয় জনতা পার্টি, শিবসেনা, মুসলিম লীগ, ইত্তেহাদুল মুসলিমেন প্রভৃতি দলগুলি সাম্প্রদায়িক দল। এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের কাজে আত্মনিয়ােগ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।
সাম্প্রদায়িকতার বিভিন্ন মতামত
সাম্প্রদায়িকতার বহি:প্রকাশ আমরা দেখতে পাই অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ থেকে উদ্ভূত কোন বিরােধ ও বিতর্ক যখন দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা, হানাহানি, দাঙ্গা ও খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে ফেটে পড়ে। এই বিরােধ, বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার মূল নিহিত থাকে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই। বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি এবং তার থেকে উদ্ভূত আথ-সামাজিক পরিস্থিতিই সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবের মূল কারণ।
সাম্প্রদায়িকতা হল এরকম একটা অন্ধবিশ্বাস যে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম অনুসরণ করে এমন একটি গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সকলেরই একই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যাং থাকে। সাম্প্রদায়িকতা এরকম একটা বিশ্বাসের জন্ম দেয় যাতে মনে করা হয় ভারতে হিন্দু মুসলিম, খ্রিষ্টান ও শিখ প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ পৃথক ; এরা পৃথকভাবে গঠিত ও পৃথকভাবে সংহত। সাম্প্রদায়িক নেতারা তাদের অনুসরণকারীদের মনে এরকম একটা বিশ্বাস জাগায় যে তারা সকলে কেবল যে একই ধর্মীয় নিয়মবিধি মেনে চলেন তা নয়, তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থও এক। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করাতে চায় একজন মানুষের পরিচয় হবে সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক। ধর্মই হবেই তাদের সামাজিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি।
সাম্প্রদায়িক নেতারা নিজেদের অনুগামী মৌলবাদের সমর্থকদেরই কেবল জনগণ বা লােকশক্তি বলে ভাবতে পারেন, তার বাইরে সমস্ত মানুষদের প্রতিই তারা বিদ্বেষভাব পােষণ করে থাকেন। ১৯৯২ সালের ৬ই অক্টোবর হিন্দু মৌলবাদী ধর্মান্ধতা বাবরি মসজিদ বংস উপলক্ষে যে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মেতে উঠেছিল, তাকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের অন্যতম নেতা এল. কে. আদবানি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লােকশক্তির জয় বলে অভিহিত করেন। আদবানি লােকশক্তি বলতে যাদের বুঝিয়েছে তারা নিশ্চয়ই মুসলিম নন, খ্রিষ্টান নন, শিখও নন। তারা শুধুমাত্র সেইসব হিন্দু যাঁরা আদবানির মত অনুসরণ করে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তাণ্ডবলীলায় সামিল হন।
ঠিক এটাই করেছিলেন পাঞ্জাবের শিখ উগ্রপন্থী নেতা আর্নেল সিং ভিনদ্রেনওয়ালা। তিনিও মনে করেছিলেন শুধু শিখরাই হলেন জনগণ। তিনি তার সেই লােকশক্তিকে সরকারি শক্তির বিরুদ্ধে তার নিজের মত করে ব্যবহার করেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। কাশ্মীর উপত্যকায় কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট ঠিক এই কাজই করছে। তারা জনগণ বলতে শুধু কাশ্মীরী উগ্রপন্থী মুসলিমদেরই বােঝেন। এইভাবে শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাম্প্রমিক নেতারা কেবলমাত্র নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদের স্বার্থের কথাই ভাবতে পারেন।
সম্পকিতা শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে বলেই যে সেটা সক দৃষ্টিভঙ্গি, জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গি তা নয়, তারা তাদের নিজেদের সমগ্র সম্প্রদায়েরও প্রতিনিধি করে না। সাম্প্রদায়িকরা শুধু যে জাতীয় স্বার্থ দেখতে অপারগ তাই নয়— ত? তবে দমই সম্প্রদায়ের স্বার্থও দেখতে পারে না। কারণ শ্রেণীবিভক্ত সমাজে হিন, সেলিম বা যে কোন সম্প্রদায়ই হােক না কেন, সেই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষরাও বেক ও শেৰিত কোতে বিভক্ত এবং তাদের স্বার্থও ভিন্ন।
একজন কোটিপতি হিন্দুর বা মুসলিনের বা একজন খেতমজুর হিন্দু বা মুসলিমের থেকে স্বতন্ত্র। সুতরাং সাকিব বই সমগ্র হিন্দুর বা সমস্ত মুসলমানের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। তাই বলা যায়, সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে হয় সচেতন প্রবঞ্চনা বা অচেতন আত্মপ্রবঞ্চনা লুকিয়ে থাকে। সাম্প্রদায়িকরা হয় অপরকে প্রবঞ্চনা করে অথবা সে নিজেকেই প্রবঞ্চনা করছে। কারণ সে যে স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করছে, বাস্তবক্ষেত্রে সেরকম সমস্বার্থের কোন অস্তিত্ব নেই।
সবশেষে মনে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িকতা থেকে জাত হিংসা, দ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের সমগ্ৰ অংশের লাভ হয় না, লাভ হয় কতিপয় চতুর বিত্তবান ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তির। সাম্প্রদায়িকতার ভিত যেহেতু সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিহিত, সেহেতু সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করতে হলে সমগ্র সমাজকেই আমূল পাল্টানাে দরকার।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতা উন্মেষের ফল :
প্রশ্ন) সাম্প্রদায়িকতার বিষময় ফলগুলি উল্লেখপূর্বক ভারতে সাম্প্রদায়িকতা উন্মেষের কারণগুলি আলােচনা কর। সাম্প্রদায়িকতাকে কিভাবে প্রতিরােধ করা যায়?
উত্তর। সাম্প্রদায়িকতার কুফল বা পরিণতি :
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফল যে কী বিষয়ম তা বােধ হয় কাউকে নতুন করে বােঝাবার প্রয়ােজন নেই। সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী চলেছে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, সংঘর্ষ, কখনও প্রকাশ্যে, কখনও আড়ালে, কিন্তু এক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায়। ফলে সে যুগের সমাজও অন্ধকারের মধ্যে ডুবে ছিল। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলেছিল একটা বন্ধ্যা দশা। নতুন কিছু সৃষ্টির মুখ দেখেনি এই মধ্যযুগ। সাম্প্রদায়িক রেষারেষির জন্য ভারতকেও প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আমরা দেশকে অখণ্ড রাখতে পারিনি ; সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ফলে আজ কাশ্মীর জ্বলছে, পাঞ্জাব জ্বলছে, আসাম জ্বলছে, এককথায় সমগ্র ভারতবর্ষ জ্বলছে। ভারতের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে, দেশের সংহতি বিপন্ন।
জাতিতে জাতিতে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, দাঙ্গা, খুন প্রভৃতি হল সাম্প্রদায়িকতার প্রত্যক্ষ ফল। সাম্প্রদায়িকতার যেটি মারাত্মক পরিণতি সেটি হল সাম্প্রদায়িক রেষারেষি ও দাঙ্গার ফলে দেশের অর্থনীতি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়, দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়।
সাম্প্রদায়িকতা হল ভারতে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটি সর্বগ্রাসী প্রতিবন্ধক। ঐক্য হল জাতি গঠনের মূল ভিত্তিপ্রস্তর। আর সাম্প্রদায়িকতা সেই ঐক্যের মূল ধরে নাড়া দিচ্ছে ।
সাম্প্রদায়িকতা ভারতে মানবিকতা, সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব এবং মানবিক সহযােগিতার সম্পর্ককে কোণঠাসা করেছে। ধর্মীয় আবেগ ও সাম্প্রদায়িক প্রচার মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং মানুষকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সাম্প্রদায়িকতা হল ভারতীয় রাজনীতির একটি দুষ্টুগ্রহ বিশেষ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় যেটা, সেটা হল আমাদের দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ইতিমধ্যেই গভীর শিকড় গেড়ে ফেলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে লালিত ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে আজ বিপন্ন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিনাশের পরিণাম প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ অম্লান দত্ত বলেন, “দাঙ্গাবাজেরা ধর্ম সৃষ্টি করে না, অন্যের উৎপাদিত ধর্ম কেড়ে নেয়। দেশের অর্থনীতিকে এরা দুর্বল করে, রাজনীতিকে করে বিষাক্ত, গণতন্ত্রের ভিত্তি ভেঙে যায়, দেশ শেষ পর্যন্ত সামরিক শক্তির অধীনে এসে যায়।” তিনি আরও বলেন, “বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে হিন্দুদের কী উপকার হয়েছে জানি না, তবে পশ্চিম এশিয়া থেকে শুরু করে সমস্ত ইসলামি রাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে আরও দৃঢ়ভাবে জোট বেঁধেছে। আজ সারা পৃথিবীতে ভারতের প্রতি সমর্থন কমে গেছে, ভারতের রাষ্ট্র ও অর্থনীতির ওপর আস্থা দুর্বল হয়েছে। এটা সামান্য ক্ষতি নয়।)
ভারতে সাম্প্রদায়িকতা উন্মেষের কারণ :
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে নানা যুক্তি-তর্কের অবতারণা করা হয়। কেউ ইংরেজদের বিভেদ নীতিকে, কেউ ভারতীয় শাসকশ্রেণীর শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গি ও আপস নীতিকে, কেউ আবার অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিতর্ককে, কেউ হিন্দু মৌলবাদকে, কেউ মুসলিম মৌলবাদকে এ ব্যাপারে দায়ী করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা মূলত ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপার। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ভারতে যত সাম্প্রদায়িক গােলযােগ হয়েছে তার খুব অল্পসংখ্যকই মতাদর্শগত বিরােধের জন্য ঘটেছে ।
(১) শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি : আমাদের দেশের রাজনৈতিক কাঠামােয়, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা যে শিকড় গাড়তে পেরেছে তার জন্য আমাদের শাসকশ্রেণী ও শাসকদলের শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গি ও আপস নীতিকে দায়ী করা হয়। হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলিতাে আছেই, তাছাড়াও কংগ্রেস সমেত বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণীর বিভিন্ন দল নির্বাচনী লড়াইয়ে ও অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরােধ করার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করে চলেছে। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভােট পাওয়ার জন্য কংগ্রেস দল ঐ সম্প্রদায়কে তােষণ করেছে। আবার ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস হিন্দু-তােষণ নীতি অবলম্বন করে।
(২) ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি : ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা রাখার পরিবর্তে ধর্মকে নিয়েই রাজনীতি করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের আচরণে সংকীর্ণ ধর্মবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। দেশ যখন সাম্প্রদায়িক দাবানলে উত্তপ্ত, তখন রাজনৈতিক নেতাদের সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে ইমাম, শঙ্করাচার্য, মােহান্তদের দ্বারস্থ হতে দেখা যায়। মুসলিম মৌলবাদকে সন্তুষ্ট করার জন্য ঐতিহাসিক শাহ্বানু মামলার রায়কে অতিক্রম করে মুসলিম শরিয়তি আইন পাশ করা হয়েছে। আবার হিন্দু মৌলবাদকে তুষ্ট রার জন্য অযােধ্যায় রাম মন্দিরের শিলান্যাস করা হয়েছে। বলা বাহুল্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের এহেন আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিপন্থী।
(৩) মুসলিমদের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা : ভারতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার অন্যৰ্তম উৎস হল মুসলমানদের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা। ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতবর্ষে মুসলমানরা অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে থেকেছে। এতে মুসলিমদের মধ্যে একটা ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মনে এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সকল সুযােগ-সুবিধা ভােগ করছে, কিন্তু মুসলমানরা চাকুরি শিক্ষা এবং অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মুসলমানদের জন্য কোনরূপ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এর ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্রের ধারণা গড়ে উঠেছে।
(৪) সাম্প্রদায়িক দল ও সংগঠন ও ভারতে বি.জে.পি, মুসলিম লিগ, অকালি দল প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলি এবং জামাতে-ই-ইসলাম, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা, মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট, মজলিস-ই-মুসলমান প্রভৃতি সংগঠনগুলি নিজেদের বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বলে জাহির করে, সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয় এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টিতে প্ররােচনা দেয়।
(৮ সাম্প্রদায়িক সংবাদপত্র, সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তক : ভারতবর্ষে এমন অনেক সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি রয়েছে যেগুলি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিনাশের পথকে প্রশস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ অর্গানাইজার, স্বস্তিকা, আকালি পত্রিকা, সােবাত, সারসিক প্রভৃতি সংবাদপত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। এইসব সংবাদপত্র ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সংবাদকে অতিরঞ্জিত করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশকে ধ্বংস করে।
(৬) ইতিহাসের বিকৃতি : ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামােকে আঘাত করতে এবং সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন জোগাতে সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট বিকৃত মিথ্যা ইতিহাসের ভূমিকাও কম নয়। ব্রিটিশরা তাদের বিভেদ নীতির (Divide and Rule policy) অন্যতম কৌশল হিসাবে ইতিহাসকে বিকৃত করার কাজটি বেছে নেয়। ব্রিটিশ-আশ্রিত ইতিহাস চর্চার মূল অবদান হল ভারতের ইতিহাসকে তিনটি ভাগে ভাগ করা—(১) প্রাচীন বা হিন্দু যুগ, (২) মধ্য বা মুসলমান যুগ এবং (৩) আধুনিক বা ব্রিটিশ যুগ। আমাদের শেখানাে হল মুসলমান যুগে শাসকবর্গ সবই ছিল মুসলমান এবং শাসিত সকল শ্রেণীই ছিল হিন্দু। অর্ধসত্য ও মিথ্যা প্রচারে সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকেরা প্রকৃত সত্য অনুচ্চারিত রেখে দেয়। হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত সৃষ্টি রূপায়িত হয়েছে স্থাপত্য (কুতুব মিনার, তাজমহল ইত্যাদি), সঙ্গীত ও সাহিত্যে। মির্জা গালিব, আমীর খুশরু, তানসেন ভারতের নিজস্ব হয়ে ভারতের গৌরব বৃদ্ধি করেছে—এ সত্য ইংরেজরা চেপে রেখেছে।” (রনেন সেন—সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত)।
কর্ণেল মাইলস নামক এক ব্রিটিশ সেনাপতির অসত্য ও অভিসন্ধিমূলক বিবরণেব ওপর ভিত্তি করে মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লেখেন—টিপু সুলতান তিন হাজার ব্রাহ্মণকে ইসলামে দীক্ষিত করার চেষ্টা করলে তারা আত্মহত্যা করেন। শাস্ত্রী মহাশয় কিন্তু চেপে যান যে, টিপুর বার্ষিক অনুদানেই তার রাজ্যের ১৫৬টি হিন্দু মন্দির প্রতিপালিত হত, শ্রীরঙ্গপত্তন দুর্গে রঙ্গনাথজিকে দর্শন না করে টিপু কোনদিন প্রাতরাশে বসেন নি।
এইভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ফাটল রাতে চেষ্টা করেছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, মােঘল আমলে বহু হিন্দু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেন ঠিকই, কিন্তু তারা তরবারির আঘাতের ভয়ে, না ব্রাহ্মণপ্রধান হিন্দুদের নৃশংস জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবার তাগিদে এটা করেছেন সে বিষয়ে গভীর পর্যালােচনার অবকাশ আছে।
(৭) হিন্দু মৌলবাদ : ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টির পিছনে হিন্দু মৌলবাদ অনেকাংশে দায়ী। হিন্দু মৌলবাদীদের দাবি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তারা মুসলমানদের ‘বিদেশী বলে আখ্যায়িত করছে। এদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানরা ছাড়া বাদবাকি সব মুসলমানই যে এদেশে বিদেশী একথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হল দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করা মুসলমানরা যদি এদেশে বিদেশী হন, তাহলে আজ যাঁরা নিজেদের নিখাদ হিন্দু বলে দাবি করছেন, তাঁরাও কি অনেকে বিদেশীর পর্যায়ে পড়ে যাবেন না? বস্তুতপক্ষে সেই বিচারে এদেশের আদিবাসীরা ছাড়া বাদবাকি সকলেই (আর্য, রাজপুত, জাঠ ইত্যাদি) হয়ত বিদেশী হয়ে পড়বেন।
(৮) মুসলিম মৌলবাদ : ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত আবহাওয়া সৃষ্টির ব্যাপারে মুসলমান মৌলবাদীদের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনােভাব অনেকখানি দায়ী সেকথা অস্ত্রীর করা যায় না। দীর্ঘকাল যাবৎ এদেশে বসবাস করেও তারা অনেকে ভারতকে নিজের দেশ বলে ভাবতে পারেন না। শােনা যায়, ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। রামায়ণ-মহাভারতের গল্প সেখানে ভীষণ জনপ্রিয়, প্রাচীন ভারতীয় নাম (সুকর্ণ, সুহাৰ্ত) তাদের ভীষণ পছন্দ ; কিন্তু ভারতে কাজী নজরুল ইসলাম বনে তাঁর সন্তানদের নাম রাখেন সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ ইত্যাদি, তখন তাকে ভারতীয় মুসলমানদের অনেকে কাফের’ বলেন। আজও ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ক্রিকেটে জিতলে ভারতের বহু মুসলমান আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন, বাজি ফাটায়, মিষ্টান্ন বিতরণ করেন। মুসলিম লিগের আক্রমণের লক্ষ্য যত না ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল কংগ্রেস পার্টির হিন্দু নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধের উপায় :
উপরের আলােচনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে ভারতের সমাজব্যবস্থায় সকত? শিকড় বহুদূর প্রসারিত। একে নির্মূল করা সহজ ব্যাপার নয়। তবুও চেষ্টার খেলে চলবে না। সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরােধের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা
(১) সারিক সাতি বজায় রাখতে গেলে রাজনীতিকে ধর্মের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
(২) দেশের সন প্রকার সাম্প্রদায়িক দল ও সংগঠনকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে। কেন কায়িক পলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া চলবে না।
(৩) বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, খালসা কলেজ প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক নামযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির নাম পরিবর্তন করেন অ-সাম্প্রদায়িক নাম দিতে হবে।
(৪) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা দূর করতে হবে।
(৫) ধর্ম ও জাতপাতের ভিত্তিতে প্রচলিত সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দারিদ্র্যের মানদণ্ডে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৬) সম্প্রদায়ভিত্তিক আসন সংরক্ষণের যে দাবি উত্থাপিত হচ্ছে সেটিকে কোনমতেই মেনে নিলে চলবে না। সম্প্রদায়ভিত্তিক আসন সংরক্ষণের দাবি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
(৭) কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভারতের মধ্যে অবস্থিত প্রতিটি সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক দাবি পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে।
(৮) উপযুক্ত গণতান্ত্রিক, সংস্কারমুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় সহনশীলতা ও অন্যান্য ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ সৃষ্টি করতে হবে।
(৯) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাপ্রবণ এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী গঠন করাও প্রয়ােজন।
(১০) প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রসারের পর্যাপ্ত সুযােগ দিতে হবে।
(১১) কোন বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে হেয় করা হয়েছে এমন পুস্তককে নিষিদ্ধ করতে হবে। তাছাড়া সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষাদান নিষিদ্ধ করতে হবে।
(১২) সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, বেতার, দূরদর্শন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কোন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রসূত প্রচারকার্য পরিচালনা নিষিদ্ধ করতে হবে।
সবশেষে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচলিত অর্থব্যঞ্জনাকেও বদলাতে হবে। সব ধর্মই সমান’ এই দৃষ্টিভঙ্গির বদলে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সবার উঁচুতে স্থান দিতে হবে। দেশের যুব সমাজকে উদ্দেশ্য করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ” মানুষের পরিচয় ধর্মে নয়, তার কীর্তিতে, তার মনুষ্যত্বে। ধর্মের মানুষ হয় না, মানুষেরই ধর্ম হয়।