ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম ও উদাহরণ

ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম ও উদাহরণ

ভাব সম্প্রসারণ এর নিয়ম:

ভাব-সম্প্রসারণ-লেখার-নিয়ম-ও-উদাহরণ

→ ভাবসম্প্রসারণ হল কোনও সংক্ষিপ্ত ভাব বা অর্থের ব্যাখ্যা অথবা বিস্তৃতি। ভাবসম্প্রসারণের জন্য উদ্ভূত পংক্তিগুলি বারবার পড়ে নিয়ে মূল ভাবটি বুঝে নিতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উদ্ধৃত অংশটিতে একটি সাধারণ অর্থ থাকে। অন্তর্নিহিত অর্থের পাশাপাশি ওই সাধারণ অর্থটিকে ভালোভাবে বোঝা জরুরি। অতিরিক্ত উদ্ধৃতি না দেওয়াই ভালো। মূল ভাবটি থেকে সম্প্রসারণটি যেন প্রসঙ্গচ্যুত না হয়। একটি বা দুটি অনুচ্ছেদে পরোক্ষভাবে ভাবটিকে ক্রমপর্যায়ে লিখতে হবে। উত্তম পুরুষ বা মধ্যম পুরুষ অর্থাৎ আমি, আমরা বা তুমি তোমরা ব্যবহার না করাই ভালো।

ভাব সম্প্রসারণের নিদর্শন

ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম:উদাহরণ

“পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও।”

[মূলভাব : ফুল তার নিজের প্রয়োজনে সুন্দর হয়ে ফোটে না, সে বিকশিত হয় সকলের মনকে আমোদিত করতে। নিজেদের কথা না ভেবে, পরের উপকার ও অকৃপণ সেবার জন্যই আমাদের ‘হৃদয়-কুসুম’কে বিকশিত করা দরকার। -তা হলেই জীবন সার্থক।] উত্তর : জীবনে আনন্দ আমরা সকলেই কামনা করি। এবং বিশ্বাস করি সুখই জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে। কিন্তু মানুষ যদি ভাবে এই সুখ এবং আনন্দ সে একাকীই ভোগ করবে এবং একাকী ভোগের মধ্যে দিয়েই জীবন হবে সার্থক; তাহলে তার জীবন কখনোই সার্থক হয়ে উঠবে না। ছোট বক্তব্যটির মধ্যে দিয়ে এই কথাটিই নির্দেশিত। মনুষ্য জীবনের সার্থকতা স্বার্থপরতায় নয়, পরার্থপরতায়। প্রকৃতি জগতে ফুল পরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবার ব্রত গ্রহণ করেছে। পুষ্প বর্ণে নয়নরঞ্জক, গন্ধে চিত্তহারী। পুষ্প বৃত্ত থেকে ছিন্ন হয়ে দেবতার পায়ে নিবেদিত হয়ে তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। দেবতা এবং মানুষ ছাড়াও ভ্রমর, প্রজাপতি ও কীট পতঙ্গের কাছে পুষ্পের আকর্ষণ দুর্বার। মাটি থেকে প্রাণরস সঞ্চয় করে গাছ ধীরে ধীরে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে তোলে, সে ফুল ফোটায়। সেই ফুল বর্ণে, গন্ধে অপরকে তুষ্ট করে। সেবায় লাগে। মহাপুরুষেরা অনুরূপভাবে আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পরের উপকার করে থাকেন। তাঁদের জীবন যেন পরের জন্য উৎসর্গীকৃত। এ জাতীয় মানুষের সংখ্যা যে সমাজে যত বেশি, সে সমাজ তত উন্নত। তত সত্য। তত সমৃদ্ধ।

* সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই ॥

[মূলভাব : মানবসভ্যতার প্রকৃত পরিচায়ক হল ‘মনুষ্যত্ব’। দয়া মায়া ভালোবাসা ইত্যাদির মধ্যেই মনুষ্যত্বের যথার্থ পরিচয়। ধর্ম, বর্ণ, জাতি ইত্যাদি ভেদ সৃষ্টি করে মানুষকে বিনাশ করা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।]

• উত্তর : মানুষই হল ভগবানের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষের থেকে বড় এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। বুদ্ধি, বিবেচনা ও ধর্মবোধ সবদিক দিয়ে মানুষ আর সকলের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। মনুষ্যত্বেই মানুষের যথার্থ পরিচয়। এই মনুষ্যত্ব দেশ কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষকে সেবার মধ্যে
দিয়ে এই মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। আর এই মনুষ্যত্ব সঠিকভাবে অর্জিত হলেই সৃষ্টি হয় মানুষের প্রতি নিবিড় বন্ধন, মানুষের সঙ্গে প্রেম প্রীতির মধুর সম্পর্ক।

কিন্তু বাস্তবে প্রায়শই এর বিপরীত ছবিটি চোখে পড়ে। দেখা যায় কিছু মানুষ সংস্কারের বেড়াজালে আটকে পড়েছে, তার মধ্যে গড়ে উঠেছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির বিভেদ। এই বিভেদ কখনোই অভিপ্রেত নয়। মানুষকে অপমান, অবহেলা বা অবজ্ঞার দ্বারা দূরে সরিয়ে রাখলে মনুষ্যত্বেরই অপমান হয়। মনুষ্যত্বের অপমানের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিধাতাই অপমানিত হন। —এই অপমান কখনোই সমর্থন করা যায় না। এই জগতে কোন মানুষকে ঘৃণা, অবহেলা বা অবজ্ঞা করে দূরে সরিয়ে রাখা উচিত নয়। কারণ মানুষ মানুষেরই জন্য। মানুষ এবং তার মনুষ্যত্বই হল চিরসত্য। তাই মানুষের মধ্যে উচ্চ নীচ, ধনী, দরিদ্র এই ভেদ না করে সবাইকে আপন করে নেওয়াই আমাদের কর্তব্য। এই কর্তব্যের মধ্যেই পাওয়া যায় মনুষ্যত্বের যথার্থ পরিচয়। মানবজীবনের সার্থকতা।

* যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যাবে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।

[মূলভাব : সভ্যতার অগ্রগতিতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। —বিচ্ছিন্ন করে যাকে পিছনে রাখা হয়, সেই বিচ্ছিন্ন অংশ পিছন থেকে টেনে ধরে সকলকে পিছিয়ে দেয়।]

উত্তর : একদা আমাদের এই ভারতে একটা কথা দিকে দিকে প্রচারিত হত যে ‘আমরা সবাই অমৃতের পুত্র।’ পরে কবি চণ্ডীদাসও বললেন সেই একই কথা—‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ কিন্তু কালের কুটিল গতিতে ভারতবর্ষের মানুষ এই মহামন্ত্রের কথা ভুলে গেল। নানা লোকাচার, কুসংস্কার, জাত্যভিমান আজ মানুষকে হাজার রকমের কৃত্রিম বিভেদ দিয়ে পৃথক করে দিয়েছে। সামাজিক বৈষম্যের প্রাচীর মানুষকে পরস্পর থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তথাকথিত বিত্তবান এবং উচ্চজাতির ব্যক্তিরা তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মানুষদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এই সব নিম্নসম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ,—যারা দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টি, তারা সমাজের কাছে পাচ্ছে অবিচার, অবহেলা আর ঘৃণা। ফলে এই বিরাট সংখ্যক জনতা মনুষ্যেতর প্রাণীর মত জাতির একটি বিশ্লিষ্ট অঙ্গ হয়ে পশ্চাতে পড়ে রয়েছে অনগ্রসরতার অন্ধকারে।

কিন্তু একথা কে না জানে, দেশের বা সমাজের অগ্রগতি কখনো বিচ্ছিন্নভাবে হয় না। সমাজের বা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বঞ্চিত, উপেক্ষিত, শোষিত হয়ে, পিছিয়ে পড়ে থাকলে, গোটা সমাজ বা দেশ সার্বিকভাবে কখনো এগোয় না, গোটা সমাজকেই তারা নীচের দিকে টেনে রাখে, টেনে নামাতে চেষ্টা করে। সেই ব্রাত্য, অবহেলিত, অনুন্নত শ্রেণি সমগ্র সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত করে। এই ব্যাপরটিকে সহজেই মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। দেহের কোন অঙ্গ যখন হয়ে পড়ে দুর্বল বা শীর্ণ; আর বাকি অংশ থেকে যায় সুস্থ স্বাভাবিক, তখন তাকে সুস্বাস্থ্য বলা যায় না। দুর্বল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে কোন মানুষ কখনো পূর্ণশক্তিতে এগিয়ে যেতে পারে না। সুস্থ সবল দেহ গঠনের জন্য চাই দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুসংগতিপূর্ণ পুষ্টি। সমাজ বা দেশের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা। শ্রেণিবৈষম্যজনিত অবিচার, শোষণ, উপেক্ষা প্রভৃতি দুর্বলতা জাতির সার্বিক অগ্রগতিকে বিঘ্ন করে। তাই, সমাজ বা দেশকে প্রগতির লক্ষে পৌঁছতে হলে বঞ্চিত, অবহেলিত, অপমানিত মানুষকে তাদের যোগ্য সম্মান ও মনুষ্যত্বের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে। অবজ্ঞায়, অবহেলায় তাদের পিছনে ফেলে রাখলে চলবে না। উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত-সমাজ,—সমাজ বা দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে সামগ্রিক মানোন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে। তবেই হবে, সমাজ বা দেশের সার্বিক কল্যাণ।

■ শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির ॥

[মূলভাব : ক্ষুদ্র ব্যক্তি নিজের সামান্য দানকে ঢাক বাজিয়ে প্রকাশ করে। পাশাপাশি তিনিই মহৎ, যিনি দান করে একেবারে নীরব থাকেন।]

উত্তর : জলভরা বিশাল দিঘি। দিঘির বিশাল বিপুল জলরাশির মধ্যেই শৈবালের জন্ম ও পরিপুষ্টি। এরজন্য দিঘি তার আশ্রিত শৈবালের কাছে কোন কৃতজ্ঞতা বা প্রতিদান প্রত্যাশা করে না। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, শৈবাল তার গায়ে যে শিশির জমে, তার এক ফোঁটা দিঘির অগাধ জলে ঢেলে গর্ব অনুভব করছে এবং আরো মজার কথা হল শৈবাল তার এই দানটুকু আবার দিঘিকে লিখে রাখতে অনুরোধ জানাচ্ছে।

এখানে শৈবাল ও দিঘির রূপকের মধ্যে দিয়ে মানবচরিত্রের একটি বিশেষ দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন। দিঘির মতন মহৎ চরিত্রের মানুষ আমরা খুব বেশি না দেখলেও শৈবালের মতন উদ্বত মানুষ প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে। এই ধরনের মানুষেরা কখনো উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখায় না) উল্টে এরা কাউকে সামান্য কিছু দিলে, সঙ্গে সঙ্গে উপকৃতের কাছে সরবে কৃতজ্ঞতা দাবি করে। এমনকী, যার আশ্রয়ে ও উপকারে সে টিকে থাকে, তার কাছেও যৎসামান্য কিছু দান করে দাতা হিসেবে বড়াই করে। এরা সামান্য কাজেরও প্রতিদান প্রত্যাশা করে।

পক্ষান্তরে যাঁরা মহৎ, উদার, তাঁরা পরের উপকার সাধনের পূণ্য কর্ম করে থাকেন নীরবে এবং নিঃশেষে সর্বস্ব বিলিয়ে দেন। তাঁরা কখনো উপকারের প্রতিদান, এমনকী কৃতজ্ঞতাও প্রত্যাশা করেন না। এর জন্য তাঁদের কোনোরকম অহংকার বা আত্মপ্রচার থাকে না। এই পৃথিবীতে দিঘির মতো মহাশয় মানুষদের কল্যাণে, তাঁদের আশ্রয়ে অনেক শেওলা-সদৃশ ব্যক্তি টিকে রয়েছে। এই ব্যক্তিদের প্রত্যুপকার করবার কোন ক্ষমতাই নেই।তবু কখনো কখনো যদি সামান্য উপকার করে বসে, তখন তা নিয়ে তারা বড়াই করে। দিঘি যেমন তার বিপুল জলরাশির নিয়ে অনেক কাজ করে এবং বহু উপকার সাধন করে থাকে) কিন্তু সেই দানের কথা শৈবালের মতো লিখে রাখতে বলে না। এখানেই ধরা পড়ে প্রকৃত দাতা এবং অকৃতজ্ঞ অনুগ্রহীতার মধ্যে কতখানি পার্থক্য। সেই পার্থক্যটিই কবি উদ্ধৃত অংশে রূপকের মাধ্যমে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েদিয়েছেন

• ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে”

[মূলভাব: ‘ক্ষমা’ মহৎ মানবিক গুণ। তা অবশ্যই দুর্বলতা নয়। কিন্তু সব জায়গায় ক্ষমার প্রয়োগ চলে না। ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতার যেখানে প্রয়োগ দরকার, সেখানে নির্মমভাবে তা প্রয়োগ করাটাকেই ঈশ্বরের আদেশ বলে ধরতে হবে।]

উত্তর : উদ্বৃত পংক্তিগুলির মধ্য দিয়ে মানুষের এক মহান নৈতিক আদর্শের কথা ঘোষিত হয়েছে। যেখানে ক্ষমা প্রদর্শন ক্ষীণ দুর্বলতারই পরিচায়ক, ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সেখানে সব দুর্বলতা পরিহার করে নির্মম নিষ্ঠুর হবার শক্তি অর্জনের জন্য ঈশ্বরের কাছে এখানে প্রার্থনা করা হচ্ছে।

অসীম করুণাময় ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ, মানুষই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তিনি বিবেক বুদ্ধি, উচিত-অনুচিত এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা শক্তি এবং সত্য-মিথ্যা জ্ঞান প্রভৃতি দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীতে ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠাই তাঁর একান্ত উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়। মানুষের মধ্য দিয়েই বিশ্বপিতার অভিপ্রায় ও জাগতিক অমোঘ বিধানের প্রকাশ ঘটে। তাই ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে মানুষকে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণে ও পালনে যোগ্য হতে হবে। মনুষ্য জন্মের সার্থকতা তাহলে দেখা দেবে অন্যায়ের প্রতিবাদে, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষমা নয়, তেজস্বিতাই কাম্য।

এমন অনেক মানুষ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছেন যারা ক্ষমাকে ভেবে থাকেন দুর্বলতা। সেক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন মানুষকে ক্ষমা করাটা কোন গুণের পরিচায়ক নয়। বরং সেই জায়গায় নিষ্ঠুর হতে হবে এবং অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে। সত্য এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য সকল ক্ষেত্রে বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে সব দুর্বলতা পরিহার করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সেই সব বিচারে ক্ষমা একটি মহৎ গুণ হলেও যেখানে তা দুর্বলতার প্রকাশরূপে উপহসিত হয়, সেখানে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নির্মমতা, কঠোরতা অবলম্বন করা জরুরি,—এইটেই হল ঈশ্বরের নির্দেশ।

* নাই ভগবান, নাইক ধর্ম যাদের শিক্ষামূলে ছিন্নমস্তা শিক্ষা সে শুধু শয়তানী ইস্কুলে ॥

[মূলভাব : শিক্ষার সঙ্গে চাই মানবধর্মের অন্বয়, চাই আস্তিক্য বোধ। যে শিক্ষায় মনুষ্যত্বের বিকাশ হয় না, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা কখনোই নয়, তা হল, ‘শয়তানী’।] –

• উত্তর : শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মনের সার্বিক বিকাশ সাধন। এই বিকাশের জন্য প্রথমত প্রয়োজন ধর্ম বা নীতির। আমাদের বিদ্যালয়ে যে শিক্ষা প্রবর্তিত রয়েছে, তা ধর্মবিবর্জিত। ধর্মহীন শিক্ষা তথাকথিত ভাবে শিক্ষা দিলেও প্রকৃত মনুষ্যত্ব দান করতে পারে না। শিক্ষার মূলে মানব ধর্ম থাকলে, তবেই আত্মার উন্নতি সাধন সম্ভব।

ধর্ম কথাটির অর্থ হল যা ধারণ করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষার মূলে ছিল ওই ধর্ম। সেই ধর্মই মানুষের মধ্যে পরলোকের চিন্তা জাগিয়ে তুলতো—যার ফলে মানুষ ইহলোকসর্বস্ব হতে পারত না। হতে পারত না পাপ-পুণ্য বোধ নিরপেক্ষ। কবির চোখে, বর্তমানের মানুষ ধর্মবিমুখ। নীতির থেকে তাঁরা বেশি দুর্নীতিপরায়ণ। শুভবুদ্ধির ধার তাঁরা ধারেন না। মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি না থাকলে সে আত্মঘাতী হয়। ছিন্নমস্তা যেমন নিজের মুণ্ড ছিন্ন করে নিজের রক্ত পান করেছেন, ধর্মহীন ও শুভবুদ্ধি হীন শিক্ষাও তেমনি আমাদের ওই ছিন্নমস্তার পথেই ঠেলে নিয়ে যাবে। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষা তখন শয়তানী শিক্ষায় পরিণত হবে। সুতরাং শুভবুদ্ধি, এবং ধর্মমূলক শিক্ষায় আমাদের শিক্ষিত হতে হবে। —এইটেই কবির নির্দেশ।

* প্রীতি-প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে, স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়ে ঘরে ৷৷

[মূলভাব : পারস্পরিক প্রেম, প্রীতি ও বন্ধুত্বের বন্ধনে সকলকে যদি বাঁধতে পারা যায়, তবেই দারিদ্রলাঞ্ছিত কুঁড়ে ঘরেই রচিত হতে পারে যথার্থ স্বর্গ। স্বর্গ অন্য কোথাও নেই।]

স্বর্গ এবং নরকে-র কথা আমরা শুনি বা জানি। পুরাকালে লোকের বিশ্বাস ছিল যে, স্বর্গ হচ্ছে পৃথিবীর ঊর্ধ্বে এক চিরসুখময় স্থান, যেখানে দেবতারা থাকেন। আর পুণ্যবানেরা মৃত্যুর

উত্তর : পরে গিয়ে সেখানে বাস করেন—এইটাই আমাদের অন্যতম বিশ্বাস।। এই পুণ্যস্থানে দুঃখ, বেদনা, হতাশা; অভাব-অনটন, হিংসা, হানাহানি প্রভৃতির লেশমাত্র নেই। পাশাপাশি নরক হল পৃথিবীর নীচের এক অপবিত্র, পূতিগন্ধময় অন্ধকার স্থানকে, যেখানে পাপীরা মৃত্যুর পরে গিয়ে শাস্তি ভোগ করে থাকে। চির আনন্দময় স্বর্গে অনন্ত সুখে যাঁরা বাস করেন তাঁদের বলা হয় দেবতা; আর -দেবতারা পূজনীয়, আবর্জনাপূর্ণ নরকে যারা অনন্ত শাস্তি ভোগ করে, তাদের বলা হয়, দানব। দানবেরা নিন্দনীয়। পুণ্যবানের জন্য স্বর্গ, আর পাপীর জন্য নরক।

কবি বল্‌ছেন, স্বর্গ-নরক বলে কোন স্থানের বাস্তব অস্তিত্ব কিন্তু নেই। এদের অস্তিত্ব রয়েছে কেবল কল্পনায়। মানুষ যখন ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, অর্থ প্রভৃতি নানান বিষয়ে নিজেদের মধ্যে কৃত্রিম বিভেদের প্রাচীর গড়ে তোলে, কিংবা যখন হিংসা, হানাহানি, অশান্তি, নিরানন্দের শিকার হয়, তখন আমাদের চিরপরিচিত এই পৃথিবীটাই হয়ে ওঠে নরক। আবার, কৃত্রিম ভেদাভেদ ভুলে যদি মানুষ পরস্পরের মধ্যে দুর্লভ প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার আত্মিক বন্ধন রচনা করতে পারে, তখনই পৃথিবী স্বর্গ সুষমায় হয়ে ওঠে উজ্জ্বল। শান্তি, সখ্য, মৈত্রী, অহিংসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা লাভ করলে জগৎ হয়ে ওঠে স্বর্গের মতই সুন্দর ও শোভন। পৃথিবীতে এই অম্লান, পবিত্র স্বর্গ তৈরী করতে হলে সমস্ত ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সংকীর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে প্রীতি-প্রেমভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে বাঁধতে হবে। কবিতাটির মধ্যে এইটেই কবির নির্দেশ। কবি তাই বিশ্বাস করেন সমস্ত রকম অন্তর্কলহ, বিদ্বেষ, ঘৃণা, স্বার্থপরতা, কৃত্রিম ভেদাভেদ ভুলে প্রীতি ও প্রেমের বন্ধনে আমরা যখন সবাই আবদ্ধ হতে পারব, তখনই আমাদের কুঁড়ে ঘরেই রচিত হবে সত্যিকারের স্বর্গ।

■ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ॥

[[মূলভাব : ক্ষুধা বা বুভুক্ষা বড়োই সর্বগ্রাসী। ক্ষুধার্তের কাছে রুটি যতখানি জরুরি, পূর্ণিমা রাত্রির সুন্দর চাঁদ ততখানি নয়। সৌন্দর্য পিপাসা মানুষের মনে আসে খালি পেটে নয়, ভরা পেটে।] উত্তর : মানুষের প্রথম এবং প্রাথমিক পরিচয় হল পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীদের মতো সেও একটা প্রাণী। জীব । জীব যখন তখন জীবন ধারণের জন্য সবথেকে বেশি তার প্রয়োজন হল টিকে থাকা। আর এই টিকে থাকাবার জন্য প্রথমেই যা দরকার তা হল ক্ষুধার অন্ন। তবে মানুষ কেবল টিকে থাকার সংকীর্ণ জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সেই সংকীর্ণ গণ্ডী অতিক্রম করে মানুষ বাঁচতে জানে। তার আরো নানা মানবিক বৃত্তি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সে টিকে থাকার গণ্ডী অতিক্রম করে বাঁচতে পারে। যেমন, মানুষ ফুল ভালোবাসে। ভালোবাসে প্রকৃতিকে। কবিতা তার ভালো লাগে। সংগীতের প্রতিও সে যথেষ্ট অনুরাগী। ভালোবাসে জ্যোৎস্নারাত্রি এবং আকাশের চাঁদকেও। আকাশের চাঁদ মানুষকে সুখ-স্বপ্ন দেখতে শেখায়। ভালোবাসার সঙ্গে এই সৌন্দর্যবোধ মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচায়ক।

ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম ও উদাহরণ

কিন্তু, কবিতাটির মধ্যে কবি অত্যন্ত সচেতন ভাবেই কঠোর বাস্তব এক চিত্রকে প্রকাশ করেছেন। কবি বলছেন, মানুষের এই সৌন্দর্যবোধ বা মানবিক বৃত্তি—এসবই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, যখন ক্ষুধার অন্ন জোটে না। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে একটুকরো ঝলসানো সেঁকা রুটি চাঁদের থেকে অধিকতর সুন্দর। কবির দেখা পূর্ণিমার চাঁদ একজন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে একটুকরো ঝলসানো রুটির প্রতীক।

ক্ষুধার রাজ্যে রুটিই সত্য। তাই এ রাজ্যে রুটি চাই, চাঁদ নয়। কবির এই ছোট্ট কবিতাটির মধ্যে দিয়ে এই বিশেষ দৃষ্টি ভঙ্গীটিই সবিশেষ প্রকাশিত।

◆ বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

[মূলভাব : নিজের নিজের পরিবেশে সব কিছুই সুন্দর। —মাতৃক্রোড়ে শিশুকে এবং বন্যপশুকে বনে দেখতেই ভালো। পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই তা অসুন্দর এবং বিসদৃশ।]
উত্তর : Harmony বা সামঞ্জস্যই হল সৌন্দর্যের আসল কথা। আর উপযুক্ত পরিবেশই সেই সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং কোন বস্তু বা দৃশ্যকে তার পটভূমিতে রেখেই সৌন্দর্য বিচার করা দরকার। এ জগতে যা কিছু সুন্দর, তা কখনোই পটভূমি নিরপেক্ষ নয়, পটভূমি সাপেক্ষ। একটি বিশেষ পরিবেশে বা পরিস্থিতিতে আমাদের চোখে যা সুন্দর বলে বিবেচিত, ভিন্ন পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে সেটিই হয়ে যেতে পারে অসুন্দর। যথাযথ পরিবেশ বা পটভূমিকার মধ্যেই সুন্দরের প্রকাশ।

এই সত্যটিকেই সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে বক্তব্যটির মধ্যে দিয়ে। আমরা জানি, আরণ্য পরিবেশে লালিত, বৃক্ষ, লতা-পাতা, ফুল দেখতে ভারি সুন্দর। কোল, ভীল, নাগা, সাঁওতাল প্রভৃতি বন্য উপজাতি বা আদিবাসীদের যথার্থ সুন্দর দেখায় অরণ্যের নিভৃত শ্যামল পরিবেশে। এই বন্য পরিবেশের সঙ্গে তাদের আকৃতি, প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে সামঞ্জস্যলাভ করে এবং তাদের সৌন্দর্য ওই পরিবেশে স্বাভাবিক দীপ্তি পায়। কিন্তু অরণ্যের এই অকৃত্রিম পরিবেশ থেকে এদের বিচ্ছিন্ন করে সভ্য জগতের কৃত্রিম পরিবেশে টেনে আনলে তাদের সহজাত স্বাভাবিক সৌন্দর্য বা বৈশিষ্ট্যের বিসদৃশ্যতা আমাদের চোখে উৎকট হয়ে ওঠে। তখনই আমরা উপলব্ধি করি বন্য মানুষের বন্য সৌন্দর্য প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিবেশেই স্বাভাবিক এবং অকৃত্রিম। অন্যথায়, তারা বেমানান এবং অসুন্দর। একইরকমভাবে, নিষ্পাপ শিশুর পরম আশ্রয় হল, তার মায়ের কোল। মাতৃস্তন্য পানরত মায়ের কাছে বা ক্রীড়াচঞ্চল শিশুর ছবি অনির্বচনীয় ও অকৃত্রিম সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। কিন্তু সেই শিশুকে তার নিরাপদ আশ্রয় মাতৃক্রোড় থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তার ওই অনির্বচনীয় সুন্দর ছবিটি দেখতে পাওয়া যায় না!

ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম ও উদাহরণ

■ ধর্মের নামে মোহ এসে যারে ধরে,
অন্ধ সে জন, মারে আর শুধু মরে ॥

[মূলভাব : ধর্মের তাৎপর্য বা মূল সত্যকে না বুঝে আমরা অনেক সময় আচার আচরণগত মোহে জড়িয়ে পড়ি। ওই মোহে আমরা নিজে মরি এবং অপরকেও মারি। ওই মোহ কখনোই ধর্ম নয়।]

উত্তর : ধর্মের মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করতে না পেরে, মানুষ যখন ধর্মের আচার-আচরণগত মোহে অন্ধ হয়ে পড়ে, তখন সে অন্যকে নিধন এবং অপরদিকে আত্মহননে উদ্যত হয়। বিশেষ বিশেষ গুণাবলিকে ধরে রাখাই হ’ল ধর্ম। আর মানুষের গুণাবলির ধারক হল, মানব ধর্ম। কিন্তু মানুষ সেই ধর্মের মহিমা অনেক সময় সম্যক্ উপলব্ধি করতে পারে না; কতকগুলি আচরণসর্বস্ব সংস্কার ও প্রথাকে ধর্ম বলে ভ্রম করে এবং সংস্কারের মোহে অন্ধ হয়ে যায়। সত্যের আলোকস্পর্শ তখন সে পায় না। সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধির শিকার হয়ে পড়ে এবং মানুষের মধ্যে এক দুর্লঙ্ঘ্য বিভেদের প্রাচীর সৃষ্টি করে। একে অপরকে ওই ধর্মের দোহাই দিয়েই আক্রমণ করে, হত্যা করে এবং চরম অমানবিক হিংস্র পাশবিকতার পরিচয় দেয়। বিশ্ববিধাতার আশীর্বাদপুষ্ট মানুষ বিধাতার মহিমা ভুলে গিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় প্রভৃতি ক্ষুদ্র সীমায় নিজেকে আবদ্ধ করে এবং ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে নির্মম নিষ্ঠুর মানসিকতার পরিচয় দেয়। এবং যে সব অপকর্ম সে তখন করে তা সবই ধর্মের নামে। অথচ মানবধর্মই মানুষের প্রকৃত ধর্ম। প্রকৃত ধর্মচেতনা মানুষকে উদার, মহৎ ও সহনশীল করে তোলে। উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব কিছু ভেদাভেদ তার উদার মানসিকতার কাছে লুপ্ত হয়ে যায়। বিশ্বমানবতার মহান আদর্শ, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি ও শুভবুদ্ধির সাধনাই তার কাছে আচরণীয় ও পালনীয় ধর্মরূপে প্রতীয়মান হয়। তখন হিন্দুমুসলমান-জৈন-বৌদ্ধ-খ্রিস্ট সব ধর্মই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়; তখনই উপলব্ধি করা যায়, ‘যত মত, তত পথ’। সুতরাং ‘ধর্ম’-এর গভীরতর তাৎপর্য না বুঝে কেবল কতকগুলি লোকাচার ও আচরণীয় রীতি-নীতির মোহে আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হয়ে থাকা সমীচীন নয়। কবিতাটির মধ্যে এই নির্দেশই সবিশেষ প্রকাশিত।

ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম ও উদাহরণ

“”★ মেঘ দেখে করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে

[মূলভাব : মিথ্যা-মেঘে অনেক সময় সত্য-সূর্য ঢাকা পড়ে যায়। দুঃখকে অতিক্রম করে সুখ যেমন আসে, তেমনই মিথ্যার মেঘ কেটে গিয়ে সত্য-সূর্য প্রকাশিত হয়। -আসলে সত্যসন্ধানে মানুষের উদ্যমটাই জরুরি।]

উত্তর : সুখ-দুঃখ, ব্যথা-আনন্দ, হাসি-কান্না, আলো-অন্ধকার নিয়েই আমাদের জীবন। ওই সত্য আমরা সকলেই জানি। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় আমরা সুখকে যেভাবে নিই; আনন্দে যেভাবে গ্রহণ করি, দুঃখ বা ব্যথাকে সেভাবে গ্রহণ করি না। মানবচরিত্রের এই বিশেষ প্রবণতাটিকে কবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

কবিতাটিতে কবি মেঘকে ভয় পেতে বারণ করেছেন। কারণ কবি জানে মেঘ চিরস্থায়ী নয়, মেঘের আড়ালে রয়েছে সূর্য—তাকে মেঘ কখনোই পুরোপুরি ঢেকে রাখতে পারবে না। এক সময়ে মেঘ অবশ্যই কেটে যাবে।’ কেটে যাবে অন্ধকার। দেখা যাবে সূর্যালোকের হাসি। স্পষ্টতই মেঘ এখানে অন্ধকার, দুঃখ, ব্যথা, হতাশার প্রতীক। জীবনে চলার পথে দুঃখ আসে। বাধা আসে। আসে আঘাত। আকস্মিক ভাবে মেঘের মতনই আসে বিপদ। কবির বিশ্বাস, এরা কেউই দীর্ঘস্থায়ী বা চিরস্থায়ী নয়। দৃঢ়চিত্তে ও স্থির বিশ্বাসে আত্মশক্তিতে আস্থা রেখে আপদ-বিপদ, বাধা-বিঘ্ন, হতাশা-নিরাশাকে অতিক্রম করলেই দেখা যাবে আশার সূর্যালোক। কেটে যাবে অন্ধকার। জীবনের একদিকে রয়েছে বিফল তার দুঃখ বেদনাবোধ আর অন্যদিকে রয়েছে বিফলতা, হতাশা, মিথ্যা, দুঃখ, ব্যথার কালোমেঘকে অতিক্রম করার আনন্দ। এই জন্যই আমাদের জীবন এই বৈচিত্রময়। এত সুন্দর।

তাই দুঃখ ব্যথা বাধা-বিঘ্নতা, ব্যর্থতা-মিথ্যাকে ভয় পেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে এরই উল্টোদিকে রয়েছে সত্য সফলতার আনন্দ। সেই আনন্দকে অর্জন করতেই হবে। এইটেই কবির নির্দেশ।

বলার অপেক্ষা রাখে, হতাশাগ্রস্ত বা দুঃখ-মিথ্যা-ব্যথা-বেদনার অন্ধকারে ঢাকা যেকোন মানুষ বা জাতির কাছে কবির এই ছোট্ট কবিতাটি একটি মৃতসঞ্জীবনী।

● যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে, যখনি জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে ॥

[মূলভাব : অন্যায়কারী নিজে খুব দুর্বল। তাই তাকে দেখে ভয় পেতে নেই। জেগে উঠে সাহসের

সঙ্গে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই অন্যায়কারী পালিয়ে যায়।] উত্তর : যাকে ভয় করা হয়,—সে যদি অন্যায়কারী হয়, তবে ওই অন্যায়কারী নিজেই অধিকতর ভীত; তাই যখনই সে বাধা পায়, তখনই প্রতিহত’ হয়ে সে তাড়াতাড়ি পালাতে বাধ্য হয়। অন্যায়কারী তার অন্যায় বোধে অন্তরে খুবই দুর্বল। কিন্তু তার অন্যায় বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ না থাকায়, তার সাহস বেড়ে যায়। একের ভয় অন্যকে সাহস যোগায়; অপরের দুর্বলতা অন্যজনকে সবল করে তোলে। ফলে, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে ধনী দরিদ্রকে অত্যাচার করে। সহায়সম্বলহীন দরিদ্র তার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে ভয় পায় বলেই ওই ধনী আরো সাহসী হয়ে ওঠে। তাই, যুগে যুগে পৃথিবীর যে কোন দেশের ইতিহাসেই দেখা যায় দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার যেন চিরসত্য। আবার ইতিহাসই প্রমাণ করে দেয়,—যখনই অত্যাচারিত জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তখনই সেই অত্যাচারী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। আঘাতকারীকে তাই প্রত্যাঘাতেই সংযত রাখা যায়; বলের বিরুদ্ধে প্রয়োজন হয় বল-প্রয়োগের; দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় দল। এই প্রতিরোধ না থাকলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠত এই পৃথিবী। পৃথিবী হয়ে উঠত শক্তিশালী অত্যাচারীদের বাসস্থান। মানুষের ন্যায়-নীতিবোধ আছে; জ্ঞান-বিবেকবুদ্ধি আছে; ন্যায়অন্যায় আদর্শবোধ আছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মানুষের স্বভাবধর্ম। তাই দেখা যায়, প্রবল

অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে নিপীড়িত দুর্বল জনগণ প্রয়োজনবোধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হলে, প্রবল শাসক দুর্বল শাসিতের কাছে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয় এবং পলায়ন ছাড়া তার তখন আর কোন উপায় থাকে না।

ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম

ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়ম ও উদাহরণ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *