সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে কি জান? সমাজতন্ত্রবাদের মূল আদর্শগুলি কি কি?

সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে কি জান? সমাজতন্ত্রবাদের মূল আদর্শগুলি কি কি?

প্রশ্ন । (ক) ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে কি জান?

(খ) সমাজতন্ত্রবাদের মূল আদর্শগুলি কি কি? সমাজতন্ত্রবাদের প্রতি ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও জার্মান সরকারের মনোভাব কি ছিল?

(গ) কার্ল মার্কস পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রগতি আলোচনা কর। পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের সঙ্গে কোন্ কোন্ বিষয়ে মার্কসের মতপার্থক্য দেখা যায়?

সমাজতন্ত্রবাদ ঊনবিংশ শতাব্দীতে:

উত্তর।

সমাজতন্ত্রবাদ: ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে সমাজতন্ত্রবাদের উত্থান নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের পরিণতির সাথে সাথেই সমাজতন্ত্রবাদের বিরাট আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এই শতাব্দীতে যে সমস্ত শক্তির সংঘাতের ফলে ইওরোপীয় ইতিহাস রচিত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাব সুস্পষ্ট। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তি বিচার না করিয়া এই যুগের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সূচনা

সমাজতন্ত্রবাদ-সম্পর্কে-কি-জান-সমাজতন্ত্রবাদের-মূল-আদর্শগুলি-কি-কি?

(১) সমাজতন্ত্রবাদের উৎপত্তি :

(ক)ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা:
ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার আংশিক বিকাশ মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায়। সমাজে অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য দূর করার উদার কামনা হইতেই এই সমস্ত ভাবধারা বিকাশ লাভ করিয়াছিল।

মূর (Moore) তাঁহার ‘Utopian’ গ্রন্থে একটি আদর্শ সমাজের চিত্র অঙ্কন করিয়াছিলেন; সেখানে সম্পত্তি বলিতে কিছু থাকিবে না এবং সকলেই সামর্থ্য অনুযায়ী সামাজিক কার্যে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত থাকিবে। এইসব ভাবধারা কেবলমাত্র কল্পনাতেই পর্যবসিত ছিল। ফরাসী বিপ্লবের মধ্যে সর্বপ্রথম এই ভাবধারাকে আংশিকভাবে কার্যকর করিয়া তুলিবার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসী কৃষক-সম্প্রদায়ের সন্তান ফ্রাঙ্কয়েস বেবিউফ (Francois Babeuff) সরকারের কর্তৃত্বাধীনে সমগ্র জাতীয় আয় বন্টনের এক পরিকল্পনা করেন এবং এই পরিকল্পনা কার্যে পরিণত করার তাগিদে তিনি শাসনতন্ত্র দখল করিবার এক ষড়যন্ত্রও করেন। উহা অবশ্য ব্যর্থ হয় এবং তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। সুতরাং ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব হইতেই অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীকরণের চেষ্টা চলিয়া আসিতেছিল। যদিও তাহা তখনও সমাজতন্ত্রবাদ আখ্যা লাভ করে নাই।

সমাজতন্ত্রবাদ:(খ)শিল্প-বিপ্লবের ফলে কারখানা-প্রথার সৃষ্টি

শিল্প-বিপ্লবের ফলে দেশে দেশে উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল, উৎপাদনের জন্য কারখানা প্রথার সৃষ্টি হইয়াছিল। কারখানা প্রথায় উৎপাদনের ফলে দেশে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইয়া দেশ সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিয়াছিল সত্য, কিন্তু সে সম্পদ সমস্ত উৎপাদনকারীর মধ্যে সমভাবে বন্টিত হইল না। মূলধন কেন্দ্রীভূত হওয়াতে মূলধনী

সম্প্রদায় (capitalists) শক্তিশালী হইয়া উৎপাদিত সম্পদ হইতে আয়ের একটি বিরাট অংশ আত্মসাৎ করিবার সুযোগ পাইল এবং বিত্তশালী হইয়া উঠিল। অন্যদিকে শোষিত নিঃস্ব শ্রমিকশ্রেণী দারিদ্র্যের পেষণে ক্লিষ্ট হইতে লাগিল।
ক্রমেই মালিক ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্যের পার্থক্য বৃদ্ধি পাইল, এবং অন্যায়মূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দরিদ্র ও শোষিত সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ হিসাবেই সমাজতন্ত্রবাদ দিনের পর দিন শক্তিশালী হইয়া উঠিতে লাগিল।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সমাজে শ্রমিকশ্রেণীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল এই আদর্শের মূলমন্ত্র। বিত্তশালী মালিক ও দরিদ্র শ্রমিকদের দ্বন্দ্বে সমাজতন্ত্রবাদের উৎপত্তি

(২) সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মূল উদ্দেশ্য :

সমাজতান্ত্রিক আদর্শের আসল রূপ এবং সেই আদর্শকে কার্যে পরিণত করিবার কর্মপন্থা সম্বন্ধে সমাজতান্ত্রিকদের মধ্যে কোন সময়েই ঐক্য ছিল না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখিতে গেলে সমাজতান্ত্রিকগণ কর্তৃক প্রচারিত সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও আদর্শের মধ্যে একটি মূলগত লক্ষ্য করা যায়।

(ক) শিল্প-বিপ্লবের প্রারম্ভে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Economic theory of ‘laissez faire’) ছিল বহুল প্রচারিত নীতি। এই নীতির প্রচারকগণ রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করিয়া শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোনরূপ হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন না।

এই নীতির ফলে শক্তিশালী মালিকশ্রেণী তাহাদের দ্বারস্থ শ্রমিকদের উপর যথেচ্ছাচার ভাবে শর্ত আরোপ করিয়া শোষণ চালাইতে পারিত। সমাজতন্ত্রবাদ এই নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী, তাহারা সংখ্যায় অধিক শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষার্থে এবং মঙ্গলার্থে রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক শক্তিগুলি নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতী।

(খ) সমতার ভিত্তিতে যাহাতে অর্থবন্টন করা সম্ভব হয় তাহার জন্য সমাজতান্ত্রিকগণ জমি, মূলধন ইত্যাদি উৎপাদানের প্রয়োজনীয় সমস্ত সম্পত্তি (Means of Production) ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সমষ্টিগত বা রাষ্ট্রীয় ম মালিকানায় রাখার পক্ষপাতী। সমাজতন্ত্রবাদের ইহা একটি মূল দাবি।

(গ) এইরূপ ভাবে উৎপাদনের সমস্ত উপাদান রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে আনিয়া সমাজতান্ত্রিকগণ উৎপাদিত সামগ্রীর উপর ব্যক্তিগত অধিকার এবং সাথে সাথে মূলধনী সম্প্রদায়েরও বিলোপসাধন করিতে চান, এবং সমাজে সমতা সৃষ্টির আদর্শে পৌছাইতে চান।

(ঘ) এই পথেই, সমাজতান্ত্রিকগণের মতে শ্রমিক সাধারণের সর্বসাধারণের উন্নয়ন এবং মঙ্গলসাধন করিতে হইবে। এই কয়েকটি বিষয় শ্রমিক উন্নয়ন ও সমাজতন্ত্রবাদের এবং সাধারণত সমাজতন্ত্রবাদের মূলনীতি বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে।
সুতরাং, রাষ্ট্র কর্তৃক গণতান্ত্রিক উপায়ে উৎপাদন এবং সমতার ভিত্তিতে জাতীয় আয় বন্টনের ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রবাদ বলিয়া বর্ণনা করা সংজ্ঞা রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা উৎপাদনের উপাদানসমূহ রাষ্ট্রীয়করণের প্রয়োজনীয়তা উৎপাদনের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ও মূলধনী সম্প্রদায়ের যাইতে পারে।

(৩) বিভিন্ন প্রকারের সমাজতন্ত্রবাদ :

মৌলিক নীতির উপর সমাজতান্ত্রিকগণের মধ্যে বেশ কিছুটা ঐক্য পরিলক্ষিত হইলেও পন্থার প্রশ্নে তাঁহাদের মধ্যে যথেষ্ট অনৈক্য দেখা যায়। পন্থার প্রশ্নে মতভেদ গণতান্ত্রিক প্রথমত, ব্যক্তিগত মালিকানা হইতে উৎপাদনের উপাদানসমূহ সমষ্টিগত মালিকানায় আনিবার পন্থা সম্বন্ধে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কেহ কেহ বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব বলিয়া মনে করেন। আবার অনেকে ধর্মঘট এবং বিপ্লবের

পথ গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী বলিয়া মনে করেন। দ্বিতীয়ত, অনৈক্য আর একটি ক্ষেত্রেও দৃঢ় হয় : উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর প্রধানত মালিকানা থাকিবে কাহার? রাষ্ট্রের, না উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকের? এই রাষ্ট্রের না শ্রমিকের মালিকানা? সমস্ত অনৈক্যের জন্য সমাজতান্ত্রিকগণ বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া যায়। তৃতীয়ত, কি ধরনের রাষ্ট্রের হস্তে উৎপাদনের উপাদানসমূহ ন্যস্ত করা উচিত সে সম্বন্ধেও মতভেদ আছে।

(ক) যেমন ইংল্যাণ্ডের শ্রমিকদল মনে করেন যে এবং ফ্রান্স ও জার্মানীর কিছু কিছু , উৎপাদনের মূল উপাদানসমূহ এবং উৎপাদনের ব্যবস্থা রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হইলেই অর্থনৈতিক জীবনে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হইবে। ইহা ‘কালেক্টিভিজম্ (Collectivism) নামে পরিচিত। পন্থা হিসাবে এই ‘মডারেট’ বা নরমপন্থীগণ মনে করেন যে, ধর্মঘট এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার হস্তগত করিয়া শ্রমিকশ্রেণীর মঙ্গলসাধন করা সম্ভব।

(খ) ফ্রান্স ও ইতালির অপর এক সমাজতান্ত্রিক দল মনে করে যে, প্রত্যেক শিল্পের মালিকানা-স্বত্ব সেই শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মজুর-সঙ্ঘের উপর ন্যস্ত থাকা উচিত। ইহারা সিন্ডিক্যালিস্ট (Syndicalists) নামে পরিচিত। ইহারা রাষ্ট্রের কর্মদক্ষতায় বিশ্বাস রাখেন না। পন্থা হিসাবে তাঁহারা শ্রমিকশ্রেণীর দ্বারা বারবার ধর্মঘট ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ এবং বিপ্লবাত্মক কর্মে বিশ্বাসী।

(গ) আর একদল সমাজতন্ত্রী আছেন যাঁহারা আদর্শ হিসাবে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। ইহারা এমন একটি সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন যেখানে সমস্ত সম্পত্তি এবং উৎপাদনের ব্যবস্থা একমাত্র জনসাধারণের হস্তেই ন্যস্ত থাকিবে। এখানে ‘মজুরী-প্রথা’ (wage system) থাকিবে না, এবং কোন আইন, সরকার বা মানুষের দ্বারা উদ্ভাবিত কোন শাসনব্যবস্থা থাকিবে না।

তাঁহারা প্রাকৃতিক রাষ্ট্র স্থাপনের পক্ষপাতী। ইহারা ‘এনার্কিষ্ট’ (Anerchist) নামে পরিচিত। ফ্রান্সের ব্লাঙ্কি, রাশিয়ার সমাজতন্ত্রী নেতা বাকুনিন (Bakunin) ও ক্রোপোট্‌কিন (Kropotkin) এই মতবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ব্লাঙ্কি, বাকুনিন প্রমুখ হঠকারী সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁহাদের বক্তব্য হইল জনগণের একটি সুসংগঠিত অংশ যদি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটাতে চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহারা বিপুল সংখ্যক জনগণকে আকৃষ্ট করিতে পারিবে এবং এইভাবে বিপ্লব জয়যুক্ত হইবে।

(ঘ) ইওরোপে, বিশেষ করিয়া ইংল্যাণ্ডে অপর এক প্রকারের সমাজতন্ত্রবাদ প্রচলিত হয় যাহা গিল্ড সোস্যালিজম্’ (Guild Socialism) নামে খ্যাত। তাঁহারা উৎপাদনের উপাদানগুলিকে রাষ্ট্রীয়করণের পক্ষপাতী, কিন্তু শিল্প পরিচালনার ভার তাঁহারা দিতে চান সেই শিল্পের শ্রমিক-সংঘের উপর। ইহা ‘কালেক্টিভিজম্’ ও ‘সিন্ডিক্যালিজমের’ সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

(ঙ) আর এক প্রকার সমাজতন্ত্রী আছেন, যাঁহারা কমিউনিস্ট নামে পরিচিত এবং তাঁহাদের মতবাদকে ‘কমিউনিজম্’ (Communism) বলা হয়। তাঁহারা উৎপাদনের উপাদান রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে এবং উৎপাদন ব্যবস্থা রাষ্ট্রের পরিচালনায় আনিবার পক্ষপাতী। ইঁহাদের মতে শ্রম সকলকেই করিতে হইবে, সেই শ্রমের ফল সকলের মধ্যে সমভাবে বন্টন করিবার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে লইতে হইবে। এই মতবাদে বিশ্বাসীদের কর্মপন্থা হইতেছে বিপ্লবাত্মক।

বিপ্লবাত্মক পথে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে (Capitalist State) ধ্বংস করিয়া নূতন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করাই তাঁহাদের উদ্দেশ্য।

(৪) কার্ল মার্ক্সের পূর্বের সমাজতন্ত্রিগণ :

শিল্প-বিপ্লবের প্রসারের সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিকের আবির্ভাব হয়। এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিকগণ কল্পনা করিয়াছিলেন এমন এক সমাজব্যবস্থার, যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করিবে এবং সকলের শ্রম হইতে লব্ধ আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হইবে। ইহাদের মধ্যে কয়েকজন নিজেরাই সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।

(ক) এইরূপ একজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন ইংল্যাণ্ডের রবার্ট ওয়েন (Robert Owen)। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসাবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন; কিন্তু ফ্যাক্টরী-প্রথার যাবতীয় কুফল দেখিয়া তিনি শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতিসাধনই তাঁহার জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন।

নিউ ল্যানার্কে (New Lanark) তিনি একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করিয়া শ্রমিকসাধারণের সর্বপ্রকার উন্নতিসাধনের সার্থক চেষ্টা করেন। তাঁহার স্বার্থত্যাগ ও প্রচেষ্টায় শ্রমিকদের মধ্যে অনেক সমবায় প্রতিষ্ঠানও গড়িয়া উঠে।
তাঁহার আদর্শকে কার্যক্ষেত্রে রূপ দিবার জন্য তিনি ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘The Association of all Classes of all Nations’ নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তাঁহার আদর্শ ও কর্ম দ্বারা তিনি ইংল্যাণ্ডে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সূত্রপাত করেন।

(খ) রবার্ট ওয়েন যেরূপ ইংল্যাণ্ডে, সেন্ট সাইমন (Saint Simon) সেইরূপ ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রবাদের অগ্রদূত হিসাবে পরিগণিত হন । তিনি শিল্পরাষ্ট্র (Industrial State) গঠনের উপর জোর দিয়াছিলেন—সেখানে পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে মানুষের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা থাকিবে।

বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখিয়া একই রকম ভাবে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছিলেন চার্লস্ ফোরিয়ার (Charles Fourier)। শিল্প-জগৎ এবং শিল্পসমাজের ভিত্তি হিসাবে তিনি কল্পনা করিয়াছিলেন ‘কম্যুন’ ব্যবস্থার—যেখানে সকলে একত্রে বসবাস করিয়া প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী উৎপন্ন করিবে এবং সমতার ভিত্তিতে তাহা নিজেদের মধ্যে বন্টন করিয়া লইবে।
সেন্ট সাইমন জনকল্যাণের জন্য নিয়োজিত চার্লস্ ফোরিয়ার (১৭৭২১৮২৫ খ্রীঃ);‘কম্যুন’ ব্যবস্থা উল্লিখিত মনীষীগণ সকলেই এক একটি নূতন সমাজব্যবস্থার চিত্র কল্পনায় রঙ্গীন করিয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের পরিকল্পনাগুলি বাস্তবধর্মী না হওয়াতে স্বভাবতঃই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছিল। পরবর্তী সমাজতান্ত্রিকগণ কর্তৃক এইজন্য ইহারা ‘ইওটোপিয়ান’ (Utopian) আখ্যা পান।

(ঘ) ইহার পর খানিকটা বাস্তববাদী সমাজতন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হয় ফ্রান্সের লুই ব্লাঙ্ক (Louis Blanc )। তিনি বিশ্বাস করিতেন যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক রাষ্ট্রব্যবস্থা শ্রমিকশ্রেণীর দখলে না আসা পর্যন্ত তাহাদের উন্নতির পথ উন্মুক্ত হইতে পারে না। সুতরাং, তিনি সোজাসুজি শ্রমিকশ্রেণীর নিকট আবেদন করিয়াছিলেন ফ্রান্সের বুর্জোয়া সরকারকে (Bourgeois Government) উৎখাত করিবার জন্য। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে পুনর্গঠন করিয়া উৎপাদনের ব্যবস্থা হিসাবে

তিনি সামাজিক কারখানা (Social Workshop) প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন এবং উৎপাদনের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শোষণের অবসান করিতে চাহিয়াছিলেন।

এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিকগণ সমাজব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনিতে পারেন নাই সত্য, কিন্তু জনসাধারণের উপর তাঁহাদের প্রভাব যথেষ্ট হইয়াছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইওরোপে দুইটি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হইয়া বাস্তবে সমাজতান্ত্রিকদের উঠিয়াছিল—ইংল্যাণ্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন (তৃতীয় দশকে) এবং প্রভাব ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক-আন্দোলন (১৮৪৮ খ্রীঃ)।
এই দুইটি আন্দোলনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তাহাদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হইয়াছিল। এই সমস্ত আন্দোলনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করিয়া পরবর্তী সমাজতান্ত্রিকদের নীতি ও আদর্শ নির্ধারিত হইয়াছিল।

(৫) কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রীঃ) ঃ

—তিনি আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের স্রষ্টা—তিনি সমাজতন্ত্রবাদের এক নূতন রূপদান করেন এবং ইহা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের পথ নির্দেশ করেন। তিনি বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রবাদকে দাঁড় করাইবার জন্য সচেষ্ট হইলেন।
(i) তিনি দেখাইলেন যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল উৎস হইতেছে অর্থনীতি। ইতিহাসের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করিয়া তিনি দেখাইলেন যে, অর্থনৈতিক কারণ উদ্ভুত সংঘাতের ফলস্বরূপই ঐতিহাসিক বিবর্তন ঘটিতেছে।
(ii) তিনি আরও দেখাইলেন যে, প্রত্যেক যুগের সমাজই ছিল বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত, এবং ইতিহাস হইতেছে ঐ সমস্ত পরস্পর-বিরোধী শ্রেণী-সংঘাতের বিবরণ মাত্র। বর্তমান সমাজও পুঁজিবাদী এবং শ্রমিক—এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। ইহাদের মধ্যে পরিণতিতেই সমাজতন্ত্রবাদ এবং শ্রেণীহীন সমাজের অভ্যুদয় হইবে।
(iii) তিনি অর্থনৈতিক শাস্ত্রকে আলোচনা করিয়া দেখাইলেন যে, সমস্ত অর্থই হইতেছে কোন-না-কোন শ্রমের ফল। সুতরাং, শ্রমের মাপকাঠি দ্বারাই সমস্ত অর্থ বন্টন হওয়া দরকার।
(iv) মার্ক্স দেখাইলেন যে, এক দেশের শ্রমিকের সাথে অন্যান্য দেশের শ্রমিকের স্বার্থের যে মিল আছে, নিজদেশের মালিকশ্রেণীর মধ্যে তাহা নাই। সুতরাং, আন্তর্জাতিকতার ভিত্তিতেই শ্রমিকশ্রেণীকে সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করিতে হইবে।

মার্ক্স ও এঙ্গেল্স রচিত ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর’ (Communist Manifesto, 1884) মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই নীতি প্রচারিত হইল। প্রথমে Communist League এবং পরে International Workingmen’s Association প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহারা তাহাদের নীতিকে কার্যকর করিবার জন্য নিজেরাই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিলেন।

মার্ক্স তাঁহার সমাজতন্ত্রবাদের নূতন নাম দিলেন কমিউনিজম্ (Communism) । পূর্ববর্তী সমাজতান্ত্রিকদের সহিত অনেক ক্ষেত্রে তাঁহার কমিউনিজমের মূলগত পার্থক্য রহিয়াছে। তিনি সমাজতন্ত্রবাদকে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করিলেন
তিনি ঘোষণা করিলেন যে, সমাজতন্ত্রবাদ কোন কাল্পনিক স্বপ্ন নয়, ইতিহাসের নিয়ম অনুযায়ী ইঁহার প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী। তিনি একটি কর্মপন্থাও নির্দেশ করিলেন এবং আন্তর্জাতিকতার ভিত্তিতে আন্দোলনকে শক্তিশালী করিয়া তুলিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ কোন দেশেই জয়যুক্ত হইতে পারে নাইমার্কসের সৃষ্ট শ্রমিকদের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান (First International) নানারমক মত-বিরোধের জন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

মার্কস ও তাঁহার সহযোগী এঙ্গেল্স একদিকে যেমন ব্লাঙ্কি ও বাকুনিনের প্রদর্শিত সন্ত্রাসবাদী ও নৈরাশ্যবাদী মনোভাবের বিরোধিতা করিয়াছিলেন, অন্যদিকে শ্রেণীসংগ্রাম বিমুখ সংস্কারবাদীদের কঠোর সমালোচনা করেন। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। উহাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাতের সাথে সাথেই ভাঙ্গিয়া যায়।

কিন্তু এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও ইহা সত্য যেইওরোপের প্রায় সমস্ত দেশেই এই নূতন আদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তীব্র হইয়া উঠে, এবং অনেক দেশেই বিশেষ করিয়া জার্মানীতে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (Social .Democratic Party) খুব শক্তি সঞ্চয় করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই আন্দোলন কোথাও সম্পূর্ণ জয়যুক্ত না হইলেও বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে রাশিয়াতে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি অংশ বলশেভিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিতে সক্ষম হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *