ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্ণনা কর।
ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্ণনা কর।
প্রশ্ন । ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে ইওরোপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার একটি বিবরণ দাও।
অথবা,
ফরাসী বিপ্লব আনয়নে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ভূমিকা উল্লেখ কর।
অথবা,
১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দের ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্ণনা কর।
অথবা,
ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রীঃ) অব্যবহিত পূর্বে ফ্রান্সের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ দাও ৷
ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে: উত্তর। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ফ্রান্স ও ইওরোপের অন্যান্য দেশে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সমাজব্যবস্থাকে পূর্বতন সমাজ (the ancient regime) বলা হয়। বস্তুতপক্ষে প্রাক্বিপ্লব যুগের সামাজিক অবস্থা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পূর্বতন সমাজরূপে পরিচিত, ফ্রান্সের পূবর্তন সমাজব্যবস্থা পর্যালোচনা করিতে হইলে ঐ সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা, সামাজিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে: রাজনৈতিক অবস্থা :
ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে ইওরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। ভগবানদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী হইয়া রাজাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছিল। রাজা ছিলেন একাধারে বিচারক শাসক, আইন-প্রণেতা—এককথায় প্রজাগণের ভাগ্যনিয়ন্তা।
এইরূপ স্বৈরাচারী শাসনে জনসাধারণের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলিয়া কিছুই ছিল না। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করিয়া রাজা নিজের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী শাসনকার্য নির্বাহ করিতেন। রাজনৈতিক দিক হইতে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় ইংল্যাণ্ড ছিল সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল।
ইংল্যাণ্ডে গৌরবময় বিপ্লবের ফলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই ইংল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থা বিপ্লবের ফলে শাসনকার্য পরিচালনায় রাজার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হইয়াছিল এবং পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক ছিল না।
রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং দরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবত্তি শ্রেণীর লোকেরা তাহাদের সংখ্যানুপাতে রাজনৈতিক অধিকার হইতে বঞ্চিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে ইংল্যাণ্ডের শাসনতন্ত্র ছিল অভিজাততন্ত্রের নামান্তর।
কিন্তু ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। প্রসঙ্গত বলা যায় ইওরোপে তখন চলছিল জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার বা অনুতপ্ত রাজতন্ত্রের যুগ। কিন্তু ফ্রান্সের বুরবো
রাজবংশ ইহার দ্বারা প্রভাবিত হয় নাই। সমসাময়িক দ্বিতীয় ফ্রেডারিক, দ্বিতীয় যোসেফ, দ্বিতীয় ক্যাথারিন যখন স্বৈরাচারকে অক্ষুণ্ণ রাখিয়া প্রজা কল্যাণে কিছু সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করিয়াছিলেন, পঞ্চদশ লুই তখন অভিজাতবর্গের স্বার্থ পরিপুষ্ট করার জন্য কোন প্রকার সংস্কার নিতে চান নাই।
অথচ দাম্ভিক ভরে ‘আমিই রাষ্ট্র’ সদর্প ঘোষণার মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র বহাল রাখেন। এই সময় স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল এবং সাধারণ জনগণ অত্যাচারিত হইতেন। অন্যদিকে ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থায় কোন শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য ছিল না।
বিচার, অর্থ ও প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যে কোন যোগসূত্র ছিল না। এই ভাবে সমগ্র প্রশাসনিক কাঠামো বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা পূর্ণ হইয়া উঠে।
সামাজিক কাঠামো ঃ
ফরাসী বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বে ইওরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থাও বৈষম্য ও দুর্নীতিপূর্ণ ছিল। জনসমাজ প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং অধিকারচ্যুত মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রণী লইয়া গঠিত ছিল তৃতীয় শ্রেণী।
কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বৃহত্তর জনসমষ্টি লইয়া গঠিত তৃতীয় শ্রেণী সমস্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত ছিল। রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে সমস্ত সুখ-সুবিধা ভোগ করিত প্রথম দুই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সের অভিজাতশ্রেণীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার অর্থাৎ দেশের সমস্ত জনসংখ্যার মাত্র দেড় ভাগ।
অভিজাতরাই ছিল সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। অন্যদিকে যাজকসম্প্রদায় দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। উচ্চতর যাজকেরা সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্গত ছিল, কিন্তু নিম্নতর যাজকেরা তৃতীয় এস্টেটের সমকক্ষ ছিল।
সমাজ-জীবনে কৃষিজীবীসম্প্রদায়ের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত ছিল না। ইহাদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। জমিদারগণের জমিতে ইহারা ভূমিদাসরূপে কাজ করিত। ইহাদের কোন স্বাধীন সত্তা ছিল না।
জমিদারগণের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়াই ইহাদের দিনাতিপাত করিতে হইত। দারিদ্র্যে জর্জরিত হইয়াও ইহারা করদান কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের দুর্দশা হইতে রেহাই পাইত না।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঃ
ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে ইওরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জীবন বৈষম্য ও অন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সমাজের প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা লাভ করিত।
তাহারা করদান হইতে অব্যাহতি লাভ করিত এবং নানা প্রকার রাজার অনুগ্রহ লাভ করিত। কিন্তু যাহাদের লইয়া দেশের জনসাধারণের বিরাট অংশ গঠিত ছিল, সেই দারিদ্র্য-জর্জরিত তৃতীয় শ্রেণী অর্থাৎ কৃষকসম্প্রদায় সমস্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত ছিল, অথচ রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যপালনের সর্বাধিক দায়িত্ব ইহাদের উপরই চাপানো হইয়াছিল।
অভাব-অনটনে দিনাতিপাত করিলেও ইহাদের নিকট হইতেই সর্বাধিক পরিমাণে কর আদায় করা হইত। করভাবে জর্জরিত হইয়া কৃষকগণের আর্থিক জীবনে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়াছিল। অসাম্য ও দুর্নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ নিহিত ছিল।
পূর্বতন সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে এক বৈপ্লবিক পরিবেশ রচিত হইয়াছিল। প্রসঙ্গত বলা যায়, সমকালীন ইওরোপে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় ফ্রান্স ছিল সমৃদ্ধ, জনবহুল ও শক্তিশালী রাষ্ট্র। কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থা ছিল অসংগতিপূর্ণ। তাই ইতিহাসের অমোঘ গতিতে ফ্রান্স বিপ্লবের পথে অগ্রসর হইয়াছিল।