বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির মূল নীতিগুলি কি কি?

বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির মূল নীতিগুলি কি কি

প্রশ্ন (ক) ১৮৭১ হইতে ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জার্মানীর বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা কর।

(খ) ১৮৭১ হইতে ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিসমার্ক কিভাবে নিয়ন্ত্রক ছিলেন তাহা উল্লেখ কর।

(গ) বিসমার্ক অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির মূল নীতিগুলি কি কি? উহা কতদূর সাফল্য লাভ করিয়াছিল?

(ঘ) ত্রি-শক্তি সন্ধি গঠনের ইতিহাস আলোচনা কর।

(ঙ) ১৮৭১ হইতে ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিসমার্কের বৈদেশিক নীতির সমালোচনামূলক আলোচনা কর।

উত্তর। বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতি (১৮৭১-১৮৯০ খ্রীঃ) :

বিসমার্কের-পররাষ্ট্রনীতির-মূল-নীতিগুলি-কি-কি

বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতি: জার্মানীকে একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার পরও বিসমার্ক ১৮৭১ হইতে ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ কুড়ি বৎসর জার্মানীর চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া জার্মানীর পররাষ্ট্রনীতি সার্থকভাবে পরিচালিত করিয়াছিলেন। তাঁহার পরিচালনায় এই সময়ের মধ্যে জার্মানী ইওরোপের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত হইয়াছিল এবং ইওরোপীয় রাজনীতির কেন্দ্রস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল

যুদ্ধের পর যুদ্ধ করিয়া জার্মানীকে ঐক্যবদ্ধ করিবার পর বিসমার্ক তাঁহার পরিবর্তন আনিলেন।
(ক) পূর্বের যুদ্ধনীতির পরিবর্তে তিনি এখন ইওরোপে শান্তি বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করিলেন। নবলব্ধ জার্মানজাতির ঐক্য বজায় রাখার জন্য, সমগ্র জার্মানীর পুনরুজ্জীবনের জন্য এই শান্তির তখন প্রয়োজনীয়তা ছিল। এইজন্যই তিনি জার্মানীকে একটি ‘পরিতৃপ্ত করিলেন (“Germany is satiated country”)।

(খ) তাহার পররাষ্ট্রনীতির অপর মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সকে দুর্বল ও নির্বান্ধব অবস্থায় রাখা এবং জার্মানীর মিত্রশক্তি সব সময়েই বজায় রাখা, কারণ তিনি জানিতেন যে, সুযোগ পাইলেই ফ্রান্স তাহার প্রতিশোধাত্মক আক্রমণ শুরু করিতে পারে।

বিসমার্ক জানিতেন যে বিভিন্ন কারণে সে সময়ে ইওরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পরস্পর মৈত্রীভাব তেমন ছিল না। বিসমার্ক ইওরোপীয় দেশগুলির এই পরস্পর বিচ্ছিন্নতার সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করিলেন।

বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলি যাহাতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করিতে না পারে, অথচ জার্মানীর মিত্র যাহাতে সব সময়েই থাকে— সেদিকে তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখিতেন। ইওরোপীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিকে লইয়া (অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ইংল্যাও, ফ্রান্স ও ইতালি) তিনি যেন ওস্তাদ যাদুকরের মত খেলিতে পারিতেন

ফ্রান্সকে বিচ্ছিন্ন রাখিবার জন্য বিসমার্ক প্রথমে অস্ট্রিয়ার সহিত মিত্রতা বন্ধন দৃঢ় করিলেন। স্যাডোয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের পরও বিসমার্কের সদয় ব্যবহার এবং বন্ধান অঞ্চলে রাশিয়াকে প্রতিরোধ করিবার প্রয়োজনে অস্ট্রিয়াও এই মিত্রতা চাহিয়াছিল।

১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডার বার্লিন সফরে আসিলে বিসমার্কের চেষ্টায় জার্মানী অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার সম্রাটগণের মধ্যে এক ‘ত্রি-সম্রাটসঙ্ঘ’ (Dreikaiserbund) চুক্তি সম্পাদিত হয়। সম্রাটগণ পরস্পরের সাম্রাজ্যের অক্ষুণ্নতা বজায় রাখিতে, শান্তিপূর্ণভাবে বে বন্ধান-সমস্যা সমাধান করিতে এবং সমাজতন্ত্রবাদের অগ্রগতি রোধ করিতে স্বীকৃত হইলেন।

অস্ট্রিয়ার সহিত দ্বি শক্তি চুক্তি:

এই ‘ত্রি-সম্রাট’ চুক্তি ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে বার্লিন কংগ্রেস পর্যন্ত অটুট ছিল। বার্লিন কংগ্রেসে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার পক্ষ অবলম্বন করিয়া ‘স্যানস্টিফানোর সন্ধি’ পুনর্বিবেচনার দাবি করিলেন। ফলে রাশিয়া ত্রি-সম্রাট চুক্তি পরিত্যাগ করে। বিসমার্ক তখন অস্ট্রিয়ার সহিত মৈত্রী দৃঢ় করিবার জন্য তাহার সহিত দ্বি-শক্তি চুক্তি (Duel alliance) সম্পাদন করেন।

রাশিয়া ও ফ্রান্সের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার জন্যই এই সন্ধির প্রয়োজন ছিল; ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দের মহাযুদ্ধের মধ্যেও এই সন্ধি বজায় ছিল। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে অবশ্য বিসমার্ক বল্কান অঞ্চলের নূতন এক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ‘ত্রি-সম্রাট’ চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করিতে সক্ষম হন।

কিন্তু ১৮৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বুলগেরিয়া রুমানিয়া রাজ্যটি দখল করিয়া এক ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন রাজ্য গঠন করিতে চাহিলে রাশিয়া বাধা দেয়, এবং রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া যুদ্ধের সম্মুখীন হয়, ত্রি-সম্রাট চুক্তিরও অবসান হয়; কিন্তু বিসমার্ক রাশিয়াকে দূরে রাখিতে ভরসা করিলেন না, তাহাতে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে মিত্রতার সম্ভাবনা ছিল।

তিনি রাশিয়ার সহিত পৃথকভাবে সদ্ভাবমূলক ‘রি-ইন্‌সিওরেন্স সন্ধি (Re-insurance Treaty) স্থাপন করিলেন। এই চুক্তি দ্বারা অন্যান্য কয়েকটি জিনিসের মধ্যে ইহাও স্থির হইল যে রাশিয়া বা জার্মানী তৃতীয় কোন রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হইলে পরস্পর-সাহায্যমূলক নিরপেক্ষতা অবলম্বন করিবে ।

ত্রিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষর:

১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর-আফ্রিকার টিউনিসে উপনিবেশ লইয়া ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়; এই সুযোগে বিসমার্ক ইতালিকে দ্বি-শক্তি চুক্তিতে যোগদান করাইতে সমর্থ হন; দ্বি-শক্তি চুক্তি এখন ফ্রান্স, জার্মানী ও ইতালিকে লইয়া ত্রি-শক্তি মৈত্রীতে (Triple Alliance) পরিণত হইল।

এইরূপে ফ্রান্সকে নির্বান্ধব রাখিবার কাজ আরও অগ্রসর হয়। ফ্রান্স যাহাতে ইংল্যাণ্ডের মিত্রতা লাভ না করিতে পারে বিসমার্ক সে বিষয়েও দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন। তিনিই ইংল্যাণ্ডকে মিশর দখল করিতে উৎসাহ দেন ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করিতে সাহায্য করেন। এই সুযোগে তিনি ইংল্যাণ্ডে ও ইতালির মধ্যে এক নৌ-চুক্তি (Naval understanding) সম্পাদন করাইতে সক্ষম হন।

এইভাবে ফ্রান্স ইংল্যাণ্ড হইতে বিচ্ছিন্ন হইল। তিনি ইংল্যাণ্ডের সহিতও একটি গোপন চুক্তি সম্পাদনের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। ইংল্যাণ্ডের সাথে যাহাতে কোন দ্বন্দ্ব উপস্থিত না হয় সেইজন্য বিসমার্ক নৌ-শক্তি বৃদ্ধি বা জার্মানীর সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য আগ্রহ দেখান নাই। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে তাই তিনি মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, আমি এখন

আর উপনিবেশের জন্য উদ্গ্রীব নই (I am still no Colony Man)। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে উভয়ের মধ্যে সেইজন্য একটা চুক্তি সম্পাদিত হইতে পারিয়াছিল।

বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য:

১৮৭১ হইতে ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ কুড়ি বৎসর অসাধারণ কূটকৌশলী বিসমার্ক ইওরোপীয় রাজনীতিকে এইরূপভাবে নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিয়াছিলেন যে,
(i) ফরাসী দেশ সেডানের যুদ্ধের কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করিতে পারে নাই,
(ii) তিনি জার্মানীর স্বার্থ ও নিরাপত্তা বজায় রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন,
(iii) জার্মানীর প্রয়োজনে ইওরোপে এই সময়ে তিনি বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য শান্তি বজায় রাখিয়াছিলেন,
(iv) রাজনৈতিক কূটকৌশলের চাতুর্য দ্বারা অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড ও ইতালি এই পাঁচটি দেশের তিনটিকে তিনি সর্বদাই নিজের পক্ষে রাখিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহার সময়ে বার্লিন ইওরোপীয় রাজনীতির কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল।

তাহার পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা:

কিন্তু একটু ভাল করিয়া অনুধাবন করিলে বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির কয়েকটি দুর্বলতা ধরা পড়ে।
(১) বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি ছিল সম্ভাব্য জোটের বিরুদ্ধে জার্মানীর নেতৃত্বে সামরিক জোট সৃষ্টি করিয়া যাওয়া; কোনও মহৎ নীতি বা আদর্শের উপর ভিত্তি করিয়া ইওরোপীয় মৈত্রীসংঘ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা তিনি করিতে পারেন নাই।
(২) তিনি ইওরোপে কিছুদিন শান্তি বজায় রাখিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু এই শান্তি সামরিক শক্তির উপর ভিত্তি করিয়াছিল। ইওরোপে শান্তি-প্রতিষ্ঠার জন্য কোন মৈত্রী-সংঘ তিনি গড়িয়া তুলিতে পারেন নাই।
এই বিপজ্জনক নীতিকে সাফল্যমণ্ডিত করা তাঁহার মত ওস্তাদ কূটকৌশলীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাই তিনি অবসর গ্রহণ করিলে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁহার রচিত কূটনৈতিক কাঠামো ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের মৈত্রী জোটের মধ্যে দুর্বলতা:

(৩) তাঁহার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সহিত মৈত্রী স্থাপন এবং তাহাদের লইয়া জোট বাঁধিবার চেষ্টা অনেকক্ষেত্রেই অবাস্তব ছিল।
(ক) বিসমার্ক জার্মানীর সহিত অস্ট্রিয়া ও ইতালির মৈত্রী একসূত্রে গাঁথিয়াছিলেন, কিন্তু অস্ট্রিয়া ও ইতালির মধ্যে কোন আন্তরিক সদ্ভাব সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।

(খ) ত্রি-সম্রাট চুক্তির পশ্চাতে জার্মানীর, অস্ট্রিয়ার ও রাশিয়ার স্বার্থের কোন মিল ছিল না। বল্কান অঞ্চলে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার স্বার্থ এতই পরস্পর-বিরোধী ছিল যে, ঐ মৈত্রী দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই। অস্ট্রিয়ার সহিত এই বিরোধের ফলে এবং অস্ট্রিয়ার প্রতি জার্মানীর পক্ষপাতিত্বের ফলে রাশিয়া ফ্রান্সের প্রতি ঝুঁকিল এবং ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দেই ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে মিত্রতামুলক সন্ধি স্থাপিত হয়।

(গ) বিসমার্ক ইংল্যাণ্ডের সহিত বিরোধ পরিহারের জন্য উপনিবেশের দিকে না ঝুঁকিবার নীতি গ্রহণ করিয়াছিলেন; কিন্তু রাশিয়ার সহিত মিত্রতা রক্ষার জন্য রাশিয়ার শত্রু ইংল্যাণ্ডের সহিত তিনি প্রকাশ্যে মিত্রতা স্থাপন করিতে পারেন নাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ফ্রান্সকেও তিনি ধরিয়া রাখিতে পারেন নাই।

এই সমস্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও দীর্ঘ কুড়ি বৎসর যে তিনি জার্মানীর প্রয়োজনে ইওরোপে শান্তি বজায় রাখিতে পারিয়াছিলেন, তাহার কারণ তিনি আন্তর্জাতিক বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ এড়াইয়া চলিতে চাহিয়াছিলেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *