ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি আলোচনা Teacj Sanjib

ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি আলোচনা Teacj Sanjib

ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন

ভারতের রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করা হয় কিভাবে

প্রশ্ন । ভারতের রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করা হয় কিভাবে এবং তাঁকে পদচ্যুত করা যায় কিভাবে? [How is the President of India elected & how can he be removed from his Office?]

ভারতের-রাষ্ট্রপতির-নির্বাচন-পদ্ধতি-আলোচনা-Teacj-Sanjib

ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন উত্তর :

ভারতীয় সংবিধানের ৫৪ এবং ৫৫ নং ধারায় রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে।

ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন: সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে নিম্নলিখিত যোগ্যতার অধিকারী হতে হয় :

(ক) তিনি ভারতের নাগরিক হবেন;

(খ) তিনি কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়স্ক হবেন;

(গ) তাঁকে লোকসভার সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে;

(ঘ) তিনি পার্লামেন্ট বা কোন রাজ্য আইনসভার সদস্য হতে পারবেন না;

(ঙ) তিনি কোন সরকারী লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।

১৯৭৪ সালের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত আইনে (The Presidential Election Act, 1974) বলা হয়েছে : (i) রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে ২৫০০ টাকা জামানত হিসাবে জমা দিতে হবে, এবং (ii) প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ১০জন নির্বাচক দ্বারা প্রস্তাবিত এবং ১০জন নির্বাচক দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।

পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যগণ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচিত সদস্যগণকে নিয়ে গঠিত একটি ‘নির্বাচক সংস্থা’ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।

ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করার ব্যাপারে দু’টি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে : প্রথমত, বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্বের হার যেন একই থাকে, এবং দ্বিতীয়ত, অঙ্গরাজ্যগুলির মোট ভোট সংখ্যা পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মোট ভোট সংখ্যার যেন সমান হয়।

এই উদ্দেশ্যে প্রথমে রাজ্য বিধানসভাগুলির এবং পার্লামেন্টের প্রতিটি নির্বাচিত সদস্যের ভোট সংখ্যা কত হবে তা নির্ধারণ করতে হয়।

কোন রাজ্যের বিধানসভার প্রত্যেক নির্বাচিত সদস্যের ভোট সংখ্যা নির্ণয় করবার জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মোট জনসংখ্যাকে ঐ রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচিত মোট সদস্য সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে হয়। ভাগফলকে আবার ১০০০ দিয়ে ভাগ করে যে ভাগফল হবে সেটাই হবে ঐ রাজ্যের বিধানসভার প্রতিটি নির্বাচিত সদস্যের মোট ভোট সংখ্যা।

দ্বিতীয়বার ভাগের পর ভাগশেষ যদি ৫০০ বা তার অধিক হয় তাহলে প্রত্যেক সদস্যের ভোট সংখ্যা আর একটি করে বাড়বে। রাজ্য বিধানসভার একজন সদস্যের ভোট সংখ্যাকে ঐ রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে ঐ রাজ্যের মোট ভোটসংখ্যা পাওয়া যাবে।

১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত -নবম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ছিল ৫,৪৫৮০,৬৪৭ এবং বিধানসভার মোট নির্বাচিত সদস্য ছিল ২৯৪। সুতরাং ৫,৪৫৮০,৬৪৭ ২৯৪ = ১,৮৫,৬৪৮। এই ভাগফলকে পুনরায় ১,০০০ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হয় ১৮৫ এবং ভাগশেষ থাকে ৬৪৮।
ভাগশেষ ৫০০-র অধিক হওয়ার জন্য ১৮৫-র সঙ্গে ১ যুক্ত হয়। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের একজন বিধায়কের ভোটসংখ্যা ছিল ১৮৬। ভোটদানের সময় একজন ভোটদাতা ১টি মাত্র ভোট দেন। কিন্তু গণনার সময় ঐ ১টি ভোটের মূল্য ধরা হয় ১৮৬।

একক হস্তান্তরযোগ্য ভোট দ্বারা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব:

সকল রাজ্যের ভোট সংখ্যা যোগ করে সংখ্যা হবে সেটাই হবে পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্যগণের মোট ভোট সংখ্যা। এই মোট ভোট সংখ্যাকে পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যের ভোট সংখ্যা পাওয়া যাবে।
তবে ভাগশেষ যদি ভাজক সংখ্যার অর্ধেক বা অর্ধেকের অধিক হয়, তাহলে ভাগফলের সঙ্গে এক যোগ করতে হবে এবং সেটিই হবে একজন সাংসদের ভোটসংখ্যা। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে সকল রাজ্যের নির্বাচিত বিধায়কদের ভোটসংখ্যার যোগফল হয় ৫০১৯০৫। ফলে পার্লামেন্টের প্রতিটি নির্বাচিত সদস্যের ভোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫৭-তে।

রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতিকে ‘একক হস্তান্তরযোগ্য ভোট দ্বারা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ (Proportional representation by means of single transferable vote) বলা হয়।
এই পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যতজন প্রার্থী থাকবেন, ভোটদাতারা তাঁদের পছন্দের তারতম্য অনুযায়ী প্রত্যেক প্রার্থীর নামের পাশে ১, ২, ৩, ৪ এইভাবে সংখ্যা বসিয়ে পছন্দ প্রকাশ করবেন।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, কোন ভোটদাতা তাঁর দ্বিতীয় এবং পরবর্তী পছন্দ না জানাতেও পারেন, কিন্তু প্রথম পছন্দ তাঁকে জানাতেই হবে; নইলে তাঁর ভোটপত্র বাতিল হয়ে যাবে।

কোটা পদ্ধতি:

ভোটদান পর্ব শেষ হলে সমস্ত প্রার্থীর প্রথম পছন্দের বৈধ ভোটগুলি যোগ করা হয়। তারপর যোগফলকে ২ দিয়ে ভাগ করে ভাগফলের সঙ্গে ১ যোগ করে যে সংখ্যাটি পাওয়া

যাবে সেটিকে বলা হয় কোটা) (Quota)। প্রথম গণনায় কোন প্রার্থী ‘কোটা’য় পৌঁছতে পারলে তাঁকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। যদি কেউ ‘কোটা’ না পান তাহলে সর্বাপেক্ষা কমসংখ্যক ভোট যিনি পেয়েছেন তাঁকে বাতিল করে তাঁর ভোটপত্রে যেসব দ্বিতীয় পছন্দ দেখান হয়েছে, সেই দ্বিতীয় পছন্দের ভোটগুলি অন্য প্রার্থীদের মধ্যে হস্তান্তর করে দেখা হয় কেউ কোটা পেয়েছে কিনা। এইভাবে কোটা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ভোট হস্তান্তর চলতে থাকে।

আজ পর্যন্ত যতবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে কেবলমাত্র ১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত হতে হয়নি। উক্ত নির্বাচনে ভি.ভি.গিরি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন দ্বিতীয় পছন্দের ভোটের সাহায্যে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে কোন বিরোধ উপস্থিত হলে সেই বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব সংবিধান কর্তৃক সুপ্রীম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে (৭১ নং ধারা)।

রাষ্ট্রপতির বির্নাচন পদ্ধতিকে প্রত্যক্ষ না করে পরোক্ষ করা হয়েছে এই কারণে যে রাষ্ট্রপতি একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক। এই নিয়মতান্ত্রিক শাসকের জন্য প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বিপুল অর্থ ব্যয় করা অর্থহীন।
আর তাছাড়া প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ভিত্তিতে নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তথা মন্ত্রিপরিষদের বিরোধের সম্ভাবনা থাকত। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দ্বারা সমর্থিত ব্যক্তিই যেন রাষ্ট্রপতি পদটি লাভ করেন তা নিশ্চিত করার জন্য।

রাষ্ট্রপতির অপসারণ পদ্ধতি :

রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে কার্যকাল সমাপ্তির পূর্বেই রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করা যায়। সংবিধানের ৫৬ (১) (খ) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান ভঙ্গের অপরাধে ৬১(১) ধারায় উল্লিখিত ‘ইমপিচমেন্ট’ (Impeachment) পদ্ধতির মাধ্যমে অপসারণ করা যায়। সংবিধান ভঙ্গের অভিযোগ পার্লামেন্টের যে-কোন কক্ষে আনা যায়।
অভিযোগটি প্রস্তাবাকারে উত্থাপনের অন্তত ১৪দিন আগে নোটিশ দিতে হয়। নোটিশটি সংশ্লিষ্ট কক্ষের মোট সদস্যের কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ কর্তৃক সমর্থিত হবে। উত্থাপনকারী কক্ষে অভিযোগটি অন্ততঃ দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের দ্বারা সমর্থিত হতে হলে প্রস্তাবটি অপর কক্ষে প্রেরিত হয়। অপর কক্ষ অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে।
অনুসন্ধানকারী কক্ষের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটাধিক্যে অভিযোগ’ স্বীকৃত ও সমর্থিত হলে রাষ্ট্রপতি পদচ্যুত হন। অনুসন্ধান চলাকালে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং অথবা তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন।

লক্ষ করার বিষয়, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে পদচ্যুতির প্রস্তাব আনা যায় কেবলমাত্র সংবিধান ভঙ্গের অভিযোগের ভিত্তিতে। কিন্তু সংবিধান ভঙ্গ বলতে ঠিক কী বোঝায় এ বিষয়ে সংবিধান নীরব।
সমালোচকদের মতে, সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির কারণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকার জন্য শাসকদল বা বিরোধী দল নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে এর অপব্যাখ্যা করতে পারে। বস্তুত রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে দলের থাকবে সেই দলই এই অবস্থার সুযোগ নিতে পারে।
গণপরিষদে বিতর্কের সময় ডঃ আম্বেদকার বলেছিলেন, “সংবিধান ভঙ্গের ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক এবং ষড়যন্ত্র, উৎকোচ গ্রহণ, অন্যান্য অপরাধও এর অন্তর্ভূক্ত।”

রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের সময় বিধানসভার সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন কিন্তু পদচ্যুতির ক্ষেত্রে তাঁদের কোন এক্তিয়ার নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের সময় পার্লামেন্টের মনোনীত সদস্যদের কোন এক্তিয়ার থাকে না, অথচ পদচ্যুতির সময় তাঁদের ভোটাধিকার থাকে। বিষয়গুলি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।

কোন কোন সমালোচকের মতে, রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুতির পদ্ধতিটি বেশ জটিল। তার ওপর রাষ্ট্রপতির হাতে যেসব ক্ষমতা আছে (পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থাগিত রাখা, লোকসভা ভেঙে দেওয়া ইত্যাদি), সেসব ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি ইমপিচমেন্টের ব্যবস্থাকে বানচাল করে দিতে পারেন।
ডঃ রাও (K.V. Rao) যথার্থই বলেছেন, “There are several catches and loopholes here which will make it ineffective, almost impossible to apply it in practice.”

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *