বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা প্রবন্ধ রচনা Teacj Sanjib বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা
বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা প্রবন্ধ রচনা Teacj Sanjib
বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা
ভূমিকা : বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে আদিম যুগের পর থেকে। যে মানুষ বন্য জীবন যাপন করত একদিন ক্রমশ বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে দিয়েছে জীবনজগতের শ্রেষ্ঠত্বের আসন। মানুষ প্রকৃতিকে জয় করতে শুরু করল। সভ্যতার অরুণোদয় হল ক্রমে। আদিম কাল থেকে যে অশ্রান্ত চেষ্টা করেছে ক্রমোন্নতির জন্য তারই নাম বিজ্ঞান। বিজ্ঞানই মানবসভ্যতাকে অগ্রগতির পথে চালিত করেছে। বিশ্বপ্রকৃতির রহস্যনিকেতনের দ্বারোদঘাটনের চাবিকাঠির সন্ধানে মানুষের অন্তবিহীন যাত্রাই তার বিজ্ঞান সাধনার গোড়ার কথা, বিজ্ঞানের সাধনা সকল মানুষের স্বপ্ন, শ্রম ও অধ্যবসায়ের সম্মিলিত যোগফল, ফলে তার এই নিরলস চেষ্টাই আমাদের মন্থর ও শ্লথগতি জীবনে এনেছে দুর্বার গতি। বিজ্ঞানই মধ্যযুগের তিমির আবরণ ভেদ করে আমাদের নিয়ে এসেছে আধুনিকতার স্বর্ণদীপ্ত ঊষার দ্বারপ্রান্তে। জলে স্থলে শূন্যে মানুষের অধিকার হয়েছে বিস্তৃত।
বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ ঃ
বিজ্ঞানের জন্মলগ্নে ছিল মানুষের সামাজিক কল্যাণ-চেতনা । বিপুলা এ পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যার চাহিদা যখন সমানুপাতিক, খনির অন্ধকারে যখন পৃথিবীর খনিজসম্ভার কঠিন ঘুমে অচেতন, মানুষের ক্ষুধাহরণের জন্যে কৃষিভূমি যখন পাষাণী অহল্যার মত অভিশপ্তা, মানুষের শ্রমের উৎপাদন-শক্তি যখন সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবে নিম্নমুখী, তখনই মানুষ প্রয়োজন বোধ করেছিল এমন একটি শক্তির যে শক্তির অধীশ্বর হয়ে মানুষ দিকে দিগন্তরে বিস্তার করবে তার আধিপত্য। ফলে উত্তাল, সরোষ, সমুদ্র, নদীকে সেতু শৃঙ্খলে সে করল বন্দী। সেই উচ্ছ্বসিত জল-প্রবাহকে মানুষ ব্যবহার করল তারই প্রয়োজনে। ঊষর ভূমিকে করল শস্যময়ী। মরু প্রান্তরে আনল শ্যামল প্রাণের শিহরণ। ভূগর্ভের খনি থেকে তুলে আনল অজস্র সম্পদ। নিত্য নতুন যানবাহনের আবিষ্কার দূরের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিল। ক্রমে বিদ্যুৎশক্তি আবিষ্কৃত হল, আর সেই বিদ্যুৎ মানুষের পরম সুহৃদ হয়ে সাহায্য করল কলকারখানা গড়ে তুলতে নতুন নতুন শহর-বন্দর নির্মাণ করতে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারে দূর দূরান্তের খবর পৌঁছে গেল মুহূর্তের মধ্যে। সম্ভব হল বিজ্ঞানের কল্যাণ স্পর্শেই কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, মাঠে-প্রান্তরে সবুজ বিপ্লবের সফলতা। জীবন যাপনে এল নিশ্চয়তা। বিজ্ঞানের সঞ্জীবনী মন্ত্রেই কমে গেল অকাল মৃত্যুর হার। বশ মানল রোগ মহামারী মানুষের কাছে সৃষ্টির সেই প্রথম দিন থেকেই মানুষের বুকে কত আশা, কত সুখ, কত শোক, কত দুঃখ জমা হয়েছিল তার বুকে। হঠাৎ সে যখন সিদ্ধিলাভ করল কাগজ ও মুদ্রণ-যন্ত্র উদ্ভবের ক্ষেত্রে, সে লাভ করল মসী-অক্ষরের বর। মানুষ তার বুকের ব্যথা, মনের ভাষাকে রূপ দিয়ে বিশ্বময় তাকে ছড়িয়ে দিল। মানুষের মনে দুয়ারে দ্রুতগতিতে পৌঁছে গেল, অমর কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস। বিজ্ঞানের বলে মানুষ কালজয়ী হল। শুধু সরস্বতী নয় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও উন্মুক্ত হয়ে গেল বিজ্ঞানের কল্যাণে। মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যের শত সহস্র সুযোগ-সুবিধা লাভ করে পাড়ি জমাল পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের আবিষ্কার পরম বিস্ময়কর। প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান গেলিলিও-কেপলার-নিউটনের হাত ধরে নেমে এসে ক্যারাডে-হেলমহোৎজের দ্বারা পরিপুষ্ট হয়ে এ যুগের কুরী-আইনষ্টাইনের বিজ্ঞানীগারে কি আশ্চর্য উন্নতি ও প্রসার লাভ করেছে তা বলে শেষ করা কঠিন। এতকাল যন্ত্র, মানুষের দেহের শ্রম লাঘব করে তাকে মুক্তি দিয়েছিল
শ্রমসাধ্য কাজের হাত থেকে। বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ইলেকট্রনিকস বংশোদ্ভূত কম্পিউটার আবিষ্কার করে তার বুদ্ধি ও চিন্তার জগতে শুরু করেছে অবাধ পদচারণা। সে এখন বিশালবিশাল সংখ্যা-সম্বলিত গাণিতিক যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের নির্ভূল সমাধান নিমেষে করে দিতে পারে, শুধু তাই নয় যখন বিশৃঙ্খল ঘটনাপুঞ্জের অবর্ণনীয় ভিড়ে উদ্ভ্রান্ত মানুষের কাছে সত্যনিরূপণ হয়ে পড়ে সুদূরপরাহত, যখন সংগৃহীত বহুবিচিত্র তথ্যাবলীর পঞ্জীভূত স্তূপের মধ্য থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার কাছে হয়ে পড়ে সাধ্যাতীত। তখন কম্পিউটার তাকে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো জানিয়ে দেয় নির্ভুল পথ-নির্দেশ। অযথা স্নায়বিক চাপের হাত থেকে মুক্ত করে সে তাকে দিয়েছে শান্তির ঠিকানা। ‘রোবট’ বা ‘যন্ত্র-মানব’ আজ মানুষের হুকুমে বহু শ্রমসাধ্য কাজও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দিচ্ছে।
বিজ্ঞানের দান ঃ
ইউরোপের শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেই পৃথিবীর যন্ত্রযুগের সূত্রপাত ৷ কালে কালে সেই যন্ত্রের ঘটেছে কত রূপ-রূপান্তর, তার চালক শক্তির ঘটেছে কত পরিবর্তন, তার চালক-শক্তির স্থান কখনও নিয়েছে পশু, কখনও বায়ু, কখনও বাষ্প, কখনও বৈদ্যুতিক শক্তি, সর্বশেষে পারমাণবিক শক্তি। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দুর্বার দৈত্যের মতো যন্ত্র তার শক্তি বলে পাহাড় ভেঙ্গে রাস্তা বানিয়েছে, নদীর তটযুগলকে বেঁধেছে শক্ত কংক্রিটের সেতুবন্ধনে, জল-স্থল-অন্তরীক্ষ জয় করে এনে দিয়েছে আমাদের দুয়ারে। তাছাড়া সে কৃষিকে করেছে শস্যশালিনী, শিল্পকে করেছে অধিক উৎপাদনশীল, পথ ও পরিবহণকে করেছে সুদূরাভিসারী। যন্ত্রের শক্তিতে শক্তিমান্ মানুষ শীত-গ্রীষ্ম, বন্যা-ঝড়-ঝঞ্ঝা ইত্যাদি দুর্জয় প্রাকৃতিক তাণ্ডবের সঙ্গে আজ পাঞ্জা লড়তে পারে; আর পারে দূর দূরান্তের আর্ত পীড়িতের কাছে সেবা ও সাহায্যের কল্যাণ হস্ত প্রসারিত করে দিতে। আকাশের বিদ্যুৎকে মানুষ তার ভৃত্য করেছে—ফলে বিজলী বাতি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, টেলিভিশান প্রভৃতির সৃষ্টি হয়েছে, উন্ননতর মুদ্রাযন্ত্র বিদ্যুতের সাহায্যে চালিত হয়ে আজ অতি অল্প সময়ে ও অল্প ব্যয়ে সংবাদপত্র ও গ্রন্থ মুদ্রণে সহায়তা করছে। উন্নতি হয়েছে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের। ব্যবহারিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে তৈরি হয়েছে প্রভূত রকমারি সব বিলাস সামগ্রী। জীবন যাপনের নানাদিকেই আজ বিজ্ঞানের প্রভাব। বিজ্ঞান বুদ্ধিই খুলে দিয়েছে মানুষের সামনে অমিত শক্তির ভাণ্ডার।
বিজ্ঞান ও কুসংস্কার ঃ
কিন্তু বৈজ্ঞানিক অত্যাশ্চর্য সব আবিষ্কার আর বৈজ্ঞানিকবোধ এক জিনিস নয় ৷ জ্ঞানের দ্বারাই মানুষের অজ্ঞতা দূরীভূত হয়। অজ্ঞতাই অন্ধকার, আর সেই অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাওয়াই বিজ্ঞান বুদ্ধির উদ্দেশ্য। ব্যবহারিক জীবনে মানুষ নানা প্রথাচার, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকে। সমাজজীবনেও তার নানা ভ্রান্তিবিলাস। বিজ্ঞান পড়লেই বৈজ্ঞানিক বোধের জন্ম বা বিকাশ ঘটে না। যে শিক্ষা মনের ক্ষুদ্রতা ও ভ্রান্তির আবরণ ভেদ করে যথার্থ সত্যকে চেনায় তাই বৈজ্ঞানিকবোধ। কিন্তু এই বৈজ্ঞানিকবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে নানা বাধা, প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে অন্ধ প্রথানুগত্য, কুসংস্কার প্রধান । আর বিজ্ঞান-চেতনাহীন জীবনেই এই কুসংস্কারের শিকড় জড়িয়ে আছে। বিজ্ঞান-মনস্কতাই মানুষকে পারে এই অন্ধ-কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করতে। তাই আজকের বিজ্ঞান সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের হাঁচি, টিকটিকি, অলৌকিকতার জগৎ থেকে পরমাণু ও ইলেকট্রনের জগতে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এখানে শেষ কথা নয়। এর গ্রহণ বর্জনের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের সংস্কৃতির এমন অনেক দিক আছে যা আমাদের সমাজ জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। সেখানে সন্ধ্যার প্রদীপ, শঙ্খধ্বনি, আজানের ডাক, অন্নপ্রাশন উপনয়ন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ এ সবের মাঙ্গলিক দিককে আমরা কখনই কুসংস্কারের তালিকায়
ফেলতে পারি না। পঞ্জিকা আমরা বর্জন করতে পারি, কিন্তু দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, ঈদ, মহরমকে বর্জন করা সম্ভব নয়। যান্ত্রিক জীবনের সঙ্গে প্রাণময় উৎসবের হৃদ-স্পন্দনও সমানতালে অনুভূত হতে হবে, তা না হলে শুধু লোহালক্কড়, ইলেকট্রনিক কম্পিউটার এর দ্বারা সমাজ-সংস্কৃতির চেতনালোকে ভারসাম্য বজায় থাকবে না। তাই বর্জনের আগে চাই সার্বিক অনুসন্ধান ও যথার্থ মূল্যায়ন । বিজ্ঞান-মনস্কতা হলো এক বিশেষ মানসিক-প্রক্রিয়া, যা সব কিছুকে যাচাই করে নেওয়ার প্রবণতা গড়ে তোলে, আজ সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই বোধের প্রসারণ প্রয়োজন।
বিজ্ঞানের অভিশাপ :
বিজ্ঞান একদিকে যেমন মানব সভ্যতার বিকাশে সহায়তা করেছে, অন্যদিকে তেমনি বর্তমান যুগে সভ্যতার বিনাশেও তা সাহায্য করছে। সেজন্য বিজ্ঞানকে বলা হয়েছে ‘Handmade of war’। কথাটা যে কিরূপ রূঢ় সত্য তা বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধেই এর প্রমাণ মিলেছে। নাইট্রোগ্লিসারিন, বিষবাষ্প, ব্যাটারি, নৌবহর, বোমারু বিমান, হাউ-উইটজার প্রভৃতি এবং সর্বোপরি আণবিক বোমার যে বিধ্বংসী ক্ষমতা তা বিজ্ঞানকে আশীর্বাদের বদলে অভিশাপের ভূমিকাতেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ যেমন সভ্যতার উচ্চশিখরে আরোহণ করেছে, তেমনি তার ভীষণ সর্বধ্বংসী রূপে মানুষ আজ ভীত, স্তম্ভিত ও বিমূঢ়। বিজ্ঞানের কল্যাণপ্রসূ আবিষ্কারই মানুষের অশুভ বৃদ্ধির ফলে রূপান্তরিত হলো, নির্মম অভিশাপে নিত্য নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে ‘স্টার ওয়ার’ বা নক্ষত্র যুদ্ধের আয়োজন করে মানুষের শিয়রে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে সে হাজির হয়েছে। একদিন যন্ত্রের উপর ছিল মানুষের আধিপত্য । আজ মানুষের ওপরেই যন্ত্রের প্রভুত্ব। ধীরে ধীরে মানুষের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে অবকাশ। বিনষ্ট করেছে হৃদয়বৃত্তির অনুকূল উন্মেষ পরিবেশকে। হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও স্বার্থপরতা গ্রাস করেছে মানুষকে। যন্ত্র সভ্যতার কৃত্রিমতায় ঘটেছে মানবতাবোধের অপমৃত্যু। কৃত্রিম জীবন যাপন হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান-নির্ভর সভ্যতার অভিশাপ।
কিন্তু সত্যই কি বিজ্ঞান বিধাতার অভিশাপ? বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য কি মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করা? কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে বাস্তবিক পক্ষে বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য মানবসেবা— মানব সভ্যতার ধ্বংসসাধন বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য নয়।
বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা রচনা উপসংহার :
কি কাজে ডিনামাইট, ফায়ার-এঞ্জিন বা রকেট ব্যবহৃত হবে তা নিরূপণ করবে সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক ধর্মবুদ্ধি। মানুষ যদি আত্মম্ভরিতায় ও বুদ্ধির দোষে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তবে তার জন্য বিজ্ঞানকে অপরাধী করা চলে না। মানুষকে নীতিজ্ঞান শিখাবার ভার বিজ্ঞানের নয়। সুতরাং অগ্নি, ডিনামাইট, রকেট আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানকে গাল পড়লে চলবে না। মানুষের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক।
দাদা তোমার প্রবন্ধটি খুব ভালো হয়েছে। পরীক্ষায় আসলে আমি এটাই লিখব।