ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পদমর্যাদা আলোচনা কর-Teacj Sanjib
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পদমর্যাদা আলোচনা কর-Teacj Sanjib
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী
প্রশ্ন ; ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পদমর্যাদা আলোচনা কর।
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী:
উত্তর : ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতবর্ষে মন্ত্রিপরিষদ চালিত শাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। এই শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল একজন নামসবস্ব শাসকের অবস্থিতি। ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন সেই নামসর্বস্ব শাসক। তত্ত্বগতভাবে তিনি প্রভুত ক্ষমতার অধিকারী হলেও কার্যত তিনি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শে ঐসকল ক্ষমতা ব্যবহার করেন।
আলোচনার সুবিধার জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে : (১) শাসন সংক্রান্ত, (২) আইন সংক্রান্ত, (৩) অর্থ সংক্রান্ত, (৪) বিচার সংক্রান্ত, (৫) জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত।
ভারতের রাষ্ট্রপতির শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা:
(১) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা:
সংবিধানের ৫৩ নং ধারা অনুসারে কেন্দ্রের যাবতীয় শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত থাকবে এবং রাষ্ট্রপতি সেই সকল ক্ষমতা নিজে অথবা তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে প্রয়োগ করবেন। মন্ত্রিপরিষদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত এবং দেশের শাসন কার্যাদি সম্পর্কিত যাবতীয় সংবাদ রাষ্ট্রপতিকে জানানো প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য।
রাষ্ট্রপতির নিরোগ সংক্রান্ত ক্ষমতা ব্যাপক। তিনি যাঁদের নিয়োগ করেন তাঁরা হলেন : (ক) প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিগণ, (খ) অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালগণ, (গ) ভারতের এ্যাটর্নি জেনারেল, (ঘ) ভারতের কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল, (ঙ) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্যগণ, (চ) নির্বাচন কমিশনের সদস্যগণ, (ছ) সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগণ ইত্যাদি।
নিয়োগের ন্যায় অপসারণের ক্ষমতাও তাঁর ব্যাপক। তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাজ্যপাল, মন্ত্রীদের, এ্যাটর্নি জেনারেল প্রভৃতিকে এবং পার্লামেন্টের অনুমোদনক্রমে সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগণকে, নির্বাচন কমিশনের সদস্যগণকে, ভারতের কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল প্রমুখকে অপসারণ করতে পারেন।
রাষ্ট্রপতি হলেন দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। দেশের স্থল, নৌ ও বিমান এই তিন রক্ষিবাহিনীর প্রধানদের তিনি নিয়োগ করেন। অবশ্য যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপনের ক্ষমতা একান্তভাবে সংসদের ওপর ন্যস্ত।
দেশের আনুষ্ঠানিক প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতিই বিদেশে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেন ও বিদেশ থেকে আগত কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের গ্রহণ করেন। বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধি বা চুক্তি তাঁর নামেই সম্পাদিত হয়।
রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা:
(২) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা:
ভারতের রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রীয় আইনসভা বা সংসদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন আহ্বান করা ও স্থগিত রাখার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করা হয়েছে। কার্যকাল শেষ হওয়ার পূর্বেই রাষ্ট্রপতি লোকসভা ভেঙে দিতে পারেন। তিনি পার্লামেন্টের অধিবেশনে ভাষণ দিতে এবং ‘বাণী’ প্রেরণ করতে পারেন। এছাড়া ৮৭(৩) নং ধারা অনুসারে যে-কোন সময় তিনি পার্লামেন্টের যুক্ত অধিবেশনে ভাষণ দিতে পারেন এবং কোন আইনগত অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে উভয় কক্ষের যুক্ত অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন [১০৮(১) নং ধারা]
রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ১২ জন সদস্য এবং নিম্নকক্ষ লোকসভায় ২জন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্যকে মনোনীত করেন।
রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতীত কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। সংসদের উভয় কক্ষে অনুমোদিত হবার পর কোন বিল যখন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য প্রেরিত হয়, তখন তিনি বিলটিতে সম্মতি দিতে পারেন, না-ও দিতে পারেন, স্থগিত রাখতে পারেন অথবা পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরৎ পাঠতে পারেন। তবে এই বিল দ্বিতীয়বার উভয় কক্ষ দ্বারা অনুমোদিত হলে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিতে বাধ্য থাকেন।
- আরো পড়ুন
- ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা কর।
- ভারতের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো
এছাড়া সংসদের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালে জরুরী প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি কেন্দ্র ও যুগ্ম তালিকাভুক্ত যে-কোন বিষয়ে অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন।
রাষ্ট্রপতির অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা :
(৩) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা :
প্রত্যেক আর্থিক বছরের প্রারম্ভে সেই বছরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আনুমানিক আয়ব্যয়ের একটি বিবরণী বা ‘বাজেট’ অর্থমন্ত্রী মারফত রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের কাছে পেশ করেন। রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত কোন ব্যয়-বরাদ্দের দাবি, কর সংগ্রহ এবং ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা যায় না। আকস্মিক ব্যয় সংকুলানোর জন্য রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে ‘আকস্মিক তহবিল’ (Contingency Fund) থেকে অগ্রিম অর্থ মঞ্জুর করতে পারেন। এছাড়া, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্ব বণ্টনের জন্য রাষ্ট্রপতি প্রতি ৫ বছর ডান্তর একটি অর্থ কমিশন গঠন করেন।
রাষ্ট্রপতির বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা:
(৪) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা:
রাষ্ট্রপতির হস্তে বিচার সংক্রান্ত যেসব অর্পণ করা হয়েছে সেগুলি হল: (ক) সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগণকে নিয়োগ করা, (খ) অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করা, (গ) দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড হ্রাস করা বা স্থগিত রাখা, এমন কি মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করা, ইত্যাদি।
ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থা-সংক্রান্ত ক্ষমতা :
(৫) জরুরী অবস্থা-সংক্রান্ত ক্ষমতা :
সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে তিন ধরনের জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে (ক) জাতীয় জরুরী অবস্থা, (খ) রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণা, এবং (গ) আর্থিক জরুরী অবস্থা। সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুসারে, যুদ্ধ অথবা বহিরাক্রমণ অথবা আভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলে সমগ্র ভারতের অথবা তার কোন অংশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে বা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করলে রাষ্ট্রপতি জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা অনুসারে, কোন রাজ্যের রাজ্যপালের বিবরণ থেকে অথবা অন্য কোনভাবে রাষ্ট্রপতি যদি নিশ্চিত হন যে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যে সংবিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়, তবে তিনি শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থ৷ ঘোষণা করতে পারেন। ৩৬০ নং ধারা অনুসারে, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে, এমন অবস্থার উদ্ভব হয়েছে যার ফলে ভারতের অথবা ভারতের কোন অংশের আর্থিক স্থায়িত্ব বা সুনাম বিপন্ন হয়েছে বা বিপন্ন হবার উপক্রম হয়েছে, তাহলে তিনি আর্থিক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা:
পদমর্যাদা : রাষ্ট্রপতির এই ব্যাপক ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ রাষ্ট্রপতিকে প্রকৃত শাসক বলে দাবি করেন। তিনিই প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিগণকে নিয়োগ করেন, আবার তিনি ইচ্ছা করলে তাঁদেরকে পদচ্যুতও করতে পারেন।
তবে ভারতের সংবিধান প্রণেতারা এবং আরও অনেকে রাষ্ট্রপতিকে প্রকৃত শাসক হিসাবে মেনে নিতে রাজি নন। ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান রূপকার ডঃ আম্বেদকার বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি ইংল্যান্ডের রাজা বা রানীর ন্যায় একজন নামসর্বস্ব শাসক। তিনি দেশের প্রধান কিন্তু শাসন বিভাগের প্রধান নন। তিনি মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে বাধ্য। অনুরূপভাবে ভারতীয় সংবিধানের অপর এক স্থপতি জওহরলাল নেহরু বলেন, “আমরা রাষ্ট্রপতিকে কোন প্রকৃত ক্ষমতা অর্পণ করিনি, অবশ্য তাঁর পদটিকে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন করে তুলেছি (“We have not given any real power to the President. But we have made his position one of authority and dignity”)। রাষ্ট্রপতির পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি তাঁর ক্ষমতাহীনতারই প্রকাশ। তাছাড়া ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য।
তবে সংবিধানে যাই বলা হোক, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা নির্ভর করে ‘পদাধিকারীর ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা, যোগ্যতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। পরিস্থিতি কখনও
কখনও রাষ্ট্রপতিকে প্রকৃত শাসকের পর্যায়ে উন্নীত করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত একাদশতম লোকসভা নির্বাচনে কোন দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।