ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন গ্রন্থের পরিচয় দিয়ে বাঙলা গদ্য সাহিত্যে তাঁর দান সম্পর্কে আলোচনা কর
প্রশ্ন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন গ্রন্থের পরিচয় দিয়ে বাঙলা গদ্য সাহিত্যে তাঁর দান সম্পর্কে আলোচনা কর। তাঁকে বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী বলা হয় কেন?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন গ্রন্থের পরিচয়
অথবা
“বিদ্যাসাগরের রচনার মধ্য দিয়েই বাঙলা গদ্য সাহিত্য প্রথম সাহিত্যিক গদ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো”— বিদ্যাসাগরের লেখা গ্রন্থগুলির পরিচয় দিয়ে মন্তব্যটির সার্থকতা বিচার কর।
বাঙলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব
উত্তর। বাঙলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব নিরূপণ করতে হলে তাঁর পূর্বেকার বাঙলা সাহিত্যের স্বরূপ সম্পর্কে দু-চার কথা বলা প্রয়োজন। তবেই তাঁর কৃতিত্বের বিষয়টি সম্যকরূপে অনুধাবন করা যাবে।
প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকেরা পাঠ্যপুস্তকের মধ্য দিয়ে যে গদ্যরীতি চালালেন তা ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত চলে এলেও এই গদ্যে শ্রী-ছন্দ বড় কিছু ছিল না, তার উপর চলিত ভাষার শব্দের সঙ্গে অভিধানিক সংস্কৃত শব্দের উৎকট ব্যবহার, সর্বোপরি সংস্কৃত অথবা ইংরাজী ধাঁচে বাক্যগঠন। এই তিন কারণে এই গদ্যসাহিত্য ব্যবহারের প্রায় অনুপযোগী ছিল। যদিও সাময়িক পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাধারণ লোকের বোধগম্য ‘গদ্য কিছু চলল বটে, তবে সে রীতির অনেক দোষ ছিল। চলতি বাঙলা শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগের কোন সুনির্দিষ্ট রীতি ছিল না। বাক্যের বহর মাপসই ছিল না, আর বাক্যে ছন্দ বা তাল না থাকায় শ্রুতিমাধুর্য একেবারেই ছিল না। বাক্য রচনায় সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতিই প্রধানভাবে অবলম্বন করা হত। তা ছাড়া ছেদচিহ্নের যথোপযুক্ত প্রয়োগ না থাকায় অর্থগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটত।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন গ্রন্থের পরিচয়:
বাঙলা গদ্যের এই সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে তাকে উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যের বাহন করে তুলে অসাধ্যসাধন করেছিলেন আধুনিক বাঙলার শ্রেষ্ঠ সন্তান পুরুষসিংহ প্রাতঃস্মরণীয় মনস্বী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নিছক সাহিত্য সৃষ্টির চেয়ে লোকহিতসাধনে সাহিত্যের ব্যবহার সমস্ত শিল্পচেতনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, বিদ্যাসাগর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এই প্রত্যয়ের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরের সাহিত্য প্রচেষ্টাকে মোটামুটি দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় : (১) অনুবাদ সাহিত্য, (২) মৌলিক রচনা।
(১) অনুবাদ সাহিত্য ঃ
১৮৪৭ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত অনেকগুলি পুস্তক অনুবাদ করেছিলেন তিনি। ১৮৪৭ সালেরও পূর্বে তিনি ভাগবতের কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে ‘বাসুদেব চরিত্র’ লিখেছিলেন, কিন্তু এ বই মুদ্রিত হয় নি, আর এর পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় নি। ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হলো তাঁর ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’! এটি হচ্ছে হিন্দী ‘বেতাল পঞ্চীসী’ থেকে অনুবাদ। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকের স্বচ্ছন্দ গদ্যানুবাদ করে তিনি রচনা করলেন ‘শকুন্তলা (১৮৫৪)। ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০)। শেক্সপীয়রের ‘Comedy of Errors’ নাটকের স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করলেন তিনি ‘ভ্রান্তিবিলাসে’ (১৮৬৯)। গ্রন্থখানি ‘Comedy of Errors’ এর আক্ষরিক অনুবাদ নয়। এটিকে ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে। বিদেশী কাহিনীটিকে দেশীয় পরিচ্ছদে আবৃত করে আমাদের দেশের উপযোগী করে প্রকাশ করেছেন। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বাংলার ইতিহাস’। এটি মার্শম্যান সাহেবের রচিত ‘History of Bengal’-এর কয়েকটি অধ্যায়ের অনুবাদ। চেম্বার্স সাহেবের ‘Biographics’ অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯); এবং তাঁর ‘Rudiments of knowledge’ গ্রন্থের অবলম্বনে রচনা করলেন, ‘বোধদয়’ (১৮৫১), তাঁর ‘কথামালা’ (১৮৫৬) প্রকাশিত হয়েছিল ঈশপের Fable-গুলির অবলম্বনে। সাহিত্যকে পুষ্ট করতে গেলে বিদেশী ভাষায় লিখিত গ্রন্থের সম্পর্কে ধ্যান ধারণা থাকা দরকার; এবং তা অনুবাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব। কিন্তু অনুবাদও যে সত্যিকার সাহিত্যের মর্যাদা পেতে পারে বিদ্যাসাগর তা প্রমাণ করেছিলেন।
(২) মৌলিক রচনা ঃ
বিদ্যাসাগরের মৌলিক গ্রন্থের সংখাও বেশ কয়েকটি। চরিত্রের দিক দিয়ে পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন শিক্ষক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুদের বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য তিনি ‘বর্ণ-পরিচয়’ (১ম এবং ২য়) লিখেছিলেন; আর লিখেছিলেন ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ নামে সংস্কৃত ব্যাকরণ। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হলো তাঁর ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যবিষয়ক পুস্তক’। এটি হচ্ছে বাঙালীর হাতে লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস। তারপর প্রকাশিত হলো ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক পুস্তক’ (১৮৫৫, দু’খণ্ড) এবং ‘বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’। এর প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে, দ্বিতীয় খণ্ডটি ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে। এগুলি ছাড়া তাঁর রয়েছে আত্মজীবনী : ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ (১৮৯১)। এই আত্মজীবনীটি অসম্পূর্ণ, বাংলা সাহিত্যে এটিকেই প্রথম আত্মজীবনী হিসেবে ধরা যায়। এর আগে তিনি আর একটি গ্রন্থ রচনা করেন, তার নাম হচ্ছে ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’।
স্বনামে ছাড়া বেনামেও কিছু লেখা তিনি লিখেছিলেন। তার শত্রুপক্ষকে উদ্দেশ্য করে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ এই ছন্দ নামে স্বাদু অথচ লঘু পরিহাসের ভঙ্গীতে তিনি তিনটি ব্যঙ্গাত্মক রচনা প্রকাশ করেন। সেগুলি হলো : ‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩) এবং ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৭৪)। এইসব রসালো তির্যক আলোচনায় ঈশ্বরচন্দ্রের অশ্লীলতা ছিল না, ছিল যুক্তিপূর্ণ গভীর আলোচনা। আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য এই পুস্তিকাগুলি সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘এরূপ উচ্চ তাঙ্গের রসিকতা বাঙলা ভাষায় অতি অল্পই আছে।’ এ মন্তব্য অতিশয় যুক্তিসঙ্গত।
বাংলা গদ্যে যদি সন্নিবেশ করে, পদবন্ধে ভাগ করে এবং সুললিত শব্দ বিন্যাস করে বিদ্যাসাগর তথ্যের ভাষাকে রসের ভাষায় পরিণত করেন। বাংলা গদ্যের মধ্যেও যে এরকম ধ্বনিঝংকার ও সুরবিন্যাস সম্ভব, তা তাঁর আগে প্রায় কেউ-ই জানতেন না। তাঁর পরিকল্পিত সাধুভাষাই প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালীর লেখনীর মুখে ভাষা জুগিয়েছে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজগতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন—এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাবপ্রকাশের কঠিন বাধাসকল পরাহত করিয়া সাহিত্যের নব নব ক্ষেত্র আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া লইতে পারেন—কিন্তু যিনি এই সেনানীর রচনাকর্তা, যুদ্ধজয়ের যশোভাগ সর্বপ্রথম তাঁহাকেই দিতে হয়।”
এখানে বিদ্যাসাগরের রচনা থেকে সামান্য কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হচ্ছে—(১) “একে কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাত্রি, সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃতা; তাহাতে আবার ঘনঘটা দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল ; আর ভূতপ্রেতগণ চর্তুদিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এরূপ ‘সঙ্কটে কাহার হৃদয়ে না ভয় সঞ্চার হয়।”—‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’।
(৩) “এত বুদ্ধি না ধরিলে খুড়ো আমার এত খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিতেন না। হতভাগার বেটা কি সুভক্ষণেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। এই পৃথিবীতে অনেকের বুদ্ধি আছে, কিন্তু খুড়র মত খোশখৎ বুদ্ধি প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না। ইচ্ছা করে, খুড়র আপদ-বালাই লইয়া এই দণ্ডে মরিয়া যাই; খুড় আমার অজর, অমর হইয়া চিরকাল থাকুন।”—‘আবার অতি অল্প হইল’।
বিদ্যাসাগর বাঙলা গদ্য
উল্লিখিত দৃষ্টান্ত থেকে এ কথা সহজেই বোঝা যাবে যে বাংলা গদ্যের কায়া নির্মাণে যাঁরা দায়ী থাকুন না কেন, এর শ্রী ও হ্রী—বিদ্যাসাগরের দান। কাজেই বাঙলা সাধুভাষার গদ্যের জনক হিসাবে যাঁরা বিদ্যাসাগরকে চিহ্নিত করেন তাঁদের দাবী একেবারে অমূলক নয়। পূর্ববর্তী বাঙলা গদ্যের বিশ্লিষ্ট কঙ্কালে মেদ-মাংস-রক্ত সংযোজন এবং তাতে প্রাণ সঞ্চার করে বিদ্যাসাগরই একে সাধারণের ব্যবহার্য জীবন্ত ভাষারূপে দাঁড় করিয়ে দেন, এ কথা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে ভাষাবিদ ডঃ সুনীতিকুমারের মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্য।—“বিভিন্ন বাংলা শব্দের পরস্পর সমাবেশে অভিধানগত অর্থ ব্যতিরেকেও যে আর একটি অবর্ণনীয় রসের সৃষ্টি হইতে পারে এই অপূর্ব সত্য বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম মনে মনে অনুভব করিয়া, লেখনীর মুখে তাহার সম্ভাবনাও তাঁহার স্বদেশবাসীকে দেখাইতে সমর্থ হইয়াছেন এবং তাহার ফলেই শতাব্দীপাদের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্র এবং অর্ধশতাব্দীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব সম্ভব হইয়াছে।”