বস্তুবাদ কাকে বলে ? বস্তুবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় গুলি আলোচনা কর | সরল বস্তুবাদ

 বস্তুবাদ কাকে বলে ? বস্তুবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় গুলি আলোচনা কর | সরল বস্তুবাদ

 

বস্তুবাদ কাকে বলে? (What is Realism?)

বস্তুবাদ-কাকে-বলে-বস্তুবাদের-প্রধান-প্রতিপাদ্য-বিষয়-গুলি-আলোচনা-কর-সরল-বস্তুবাদ

 

যে জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ অনুযায়ী স্বীকার করা হয়, জ্ঞাতা (knower) এবং জ্ঞেয় বস্তু (knowing object)—উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, সেই দার্শনিক মতবাদকেই বলা হয় বস্তুবাদ (realism)। এরূপ মতবাদে দাবি করা হয় যে, জো বস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে বলেই সেগুলি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হয়। এরা কেউই তাদের অস্তিত্বের অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয়।

 

 বস্তুবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় (Main Tenets of Realism)

 

বস্তুবাদের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়রূপে যেগুলিকে উল্লেখ করা হয়, সেগুলি সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল—

 

জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাতার মননিরপেক্ষ:

 

 বস্তুবাদ অনুযায়ী স্বীকার করা হয় যে, জ্ঞাতাকে বাদ দিয়ে জ্ঞানের বস্তু তথা জ্ঞেয় বস্তু যেমন থাকতে পারে, তেমনি জ্ঞেয় বস্তুকে বাদ দিয়েও জ্ঞাতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে। এরা কেউই কারোর ওপর নির্ভরশীল নয়। সমস্ত প্রকার জ্ঞানেই একজন জ্ঞাতা যেমন থাকে, তেমনি একটি জো বস্তুও থাকে। বস্তুবাদ অনুসারে জ্ঞানের বিষয়বস্তু বা জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞাতার জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল নয়। জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাতার জ্ঞানের বাইরে স্বতন্ত্র সত্তা আছে। জ্ঞাতার জ্ঞানের ওপর জ্ঞেয় বিষয়টি নির্ভরশীল নয় বলেই কারও জানা বা না জানার ওপর জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নেপচুন গ্রহ আবিষ্কৃত হওয়ার আগে তার সম্পর্কে কারও জ্ঞান ছিল না। কিন্তু তাই বলে যেইমাত্র নেপচুন গ্রহটি সম্বন্ধে জানা গেল, তক্ষুনিই তা অস্তিত্বশীল হল এমন দাবি করা আদৌ যুক্তিসংগত নয়। কাজেই নেপচুন গ্রহটির অস্তিত্ব কখনোই আমাদের জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না, তা জ্ঞাননিরপেক্ষভাবেই অস্তিত্বশীল।

 

 জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক: 

 

বস্তুবাদ অনুযায়ী স্বীকার করা যায় যে, জ্ঞেয় বস্তুর সঙ্গে জ্ঞাতার জ্ঞানের কোনো আন্তঃসম্পর্ক (internal relation) নেই।

 

বস্তু ও জ্ঞানের আন্তঃসম্পর্কহীনতা: 

 বস্তুর সঙ্গে জ্ঞানের আন্তঃসম্পর্কটি কী? একটি বিষয় বা বস্তু যদি আর-একটি বিষয় বা বস্তুকে ছেড়ে কখনোই স্বাধীনভাবে থাকতে না পারে, তা হলে বলা হয়, ওই বিষয় বা বস্তু দুটি পরস্পরের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কিত। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে যে, বস্তুবাদ অনুসারে জ্ঞাতাকে বাদ দিয়ে বস্তুটি যেমন থাকতে পারে, তেমনি বস্তুটিকে বাদ দিয়েও জ্ঞাতা থাকতে পারে। সুতরাং, বস্তুবাদ জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর আন্তঃসম্পর্ককে কখনোই স্বীকার করে না।

 

বাহ্যসম্পর্ক: 

 জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুটির সম্পর্ক হল একপ্রকার বাহ্যসম্পর্ক। বস্তুর সঙ্গে জ্ঞাতার মনের সংযোগ ঘটলে জ্ঞানলাভ হয় আর তা না হলে জ্ঞানলাভ হয় না। কিন্তু তাই বলে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেই তাদের আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না, এমনটা নয়। যে-কোনো জ্ঞানের বস্তু আমাদের জ্ঞানের বিষয় না হয়েও স্বতন্ত্রভাবে বিরাজ করতে পারে। সে কারণেই দাবি করা যায় যে, জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক হল বাহ্য।

 

বস্তুবাদ; জগতে বিচিত্র বস্তুর সহাবস্থান: 

 

 বস্তুবাদ অনুযায়ী স্বীকার করা হয় যে, জ্ঞানের বিষয় হল বহু। এক-একটি জ্ঞানের এক একটি বিষয়। জ্ঞানের বিষয়ের ক্ষেত্রে তাই বহুত্ব আছে।

 

বহুত্ববাদ:

  আমরা বহু বিষয়কেই জানি এবং এই বিষয়গুলি হল আমাদের জ্ঞান-নিরপেক্ষ। আমাদের জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল না হয়েই এগুলি স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল। এ কারণেই বস্তুবাদী দার্শা বহুত্ববাদী (pluralists) রূপেও অভিহিত করা হয়। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, জগতে অনেক অনেক বস্তু আছে, যেগুলি পারস্পরিকভাবে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীনভাবে বিরাজমান। এই সমস্ত বিচিত্র বস্তুর যোগফলই হল এই পার্থিব জগৎ।

 

গুরুত্বহীন জাগতিক ঐক্য: 

 জ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী দার্শনিকগণ জাগতিক ঐক্যকে গুরুত্বহীন বলে মনে করেন এবং বৈচিত্রাপুর্ণ বস্তুসম্ভারের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।

 

বস্তুর স্বরূপ অনুসারে বস্তুজ্ঞান:

 

 বস্তুবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, বস্তুই আমাদের জ্ঞানকে প্রভাবিত করে, আমাদের জ্ঞান কখনোই বস্তুকে প্রভাবিত করে না। অর্থাৎ, বস্তুর স্বরূপ যেমন, আমাদের জ্ঞানও হবে ঠিক সেইরকম। এক্ষেত্রে জ্ঞাতার মনের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বরং বলা যায় যে, বস্তুই আমাদের জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

 

ভাববাদের সঙ্গে প্রকৃতিগত পার্থক্য:

 

 বস্তুবাদের সঙ্গে ভাববাদের যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়, তা হল প্রকৃতিগত (difference in nature)। কারণ ভাববাদ বস্তুবাদের বিরোধিতা করে বলে যে, জ্ঞাতা ছাড়া জ্ঞেয় বস্তু আদৌ থাকতে পারে না।

 

জ্ঞাতানির্ভর জ্ঞেয় বস্তু :

  জ্ঞাতার মনের ওপরই জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভরশীল। ভাববাদীদের মতে, আমি জ্ঞাতা হিসেবে কোনো বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করি বলেই, সেই বস্তুটি বাস্তব জগতে অস্তিত্বশীল। জ্ঞাতা-মন ছাড়া তাই বাহ্যবস্তুর স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই। জ্ঞাতা হিসেবে আমি যদি কোনো টেবিলকে না দেখি, তাহলে টেবিলটির অস্তিত্ব আছে—কী করে বলা সম্ভব? সুতরাং ভাববাদীদের মতে, জ্ঞাতার সঙ্গে জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কটি হল এক ধরনের আন্তরসম্বন্ধ (internal relation)।

 

জাগতিক ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ:

 ভাববাদী দার্শনিকগণ বস্তুবাদী দার্শনিকদের মতো বহুত্ববাদীরূপে · স্বীকৃত নন। তাঁরা মূলত অদ্বৈতবাদী (Monist)। তাদের মতে— সর্বশক্তিমান, অসীম এবং অনন্ত এক পরম সত্তা বৈচিত্র্যপূর্ণ জাগতিক সমস্ত বস্তুসত্তার মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ওপরই আমাদে একান্তভাবে নির্ভরশীল হতে হয়। সুতরাং ভাববাদী দার্শনিকগণ জাগতিক বৈচিত্র্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে, সামগ্রিকভাবে জাগতিক ঐক্যের ওপরই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

 

বস্তুবাদের প্রকারভেদ (Different Forms of Realism)

 

বস্তুবাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিভিন্ন প্রকার রূপ (forms) দেখা যায়। বস্তুবাদের সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মোট চার প্রকার বস্তুবাদের আলোচনা পর্যবেক্ষণ করি। এই চার প্রকার বস্তুবাদ হল— ১. লৌকিক বা সরল বস্তুবাদ (naive or popular realism), ২. প্রতিনিধিত্বমূলক বা বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদ (representative or scientific realism), ৩. নব্যবস্তুবাদ (neo-realism) এবং ৪. বিচারমূলক বস্তুবাদ (critical realism)। বস্তুবাদের ক্ষেত্রে এই চারটি রূপ লক্ষ করা গেলেও সরল বস্তুবাদ এবং বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এই দু-ধরনের বস্তুবাদই হল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আলোচ্য পাঠ্যসূচি অনুসারে আমরা কেবল এই দু-ধরনের বস্তুবাদই আলোচনা করব।

 

লৌকিক বা সরল বস্তুবাদ (Naive or Popular Realism)

 

বস্তুবাদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে মতবাদ দেখা যায়, তাকেই বলা হয় সরল বা লৌকিক বস্তুবাদ। এই মতবাদকে একটি যথাযথ দার্শনিক মতবাদরূপে স্বীকার করা উচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে এই মতবাদটি হল একটি লোকায়ত মতবাদ।

 

সরল বস্তুবাদের মূল বক্তব্য

 

সরল বস্তুবাদীদের মূল বক্তব্য এই যে, আমরা যে সমস্ত বস্তুর গুণ সরাসরি ভাবে প্রত্যক্ষ করি, তা বস্তুতেই নিহিত থাকে। এগুলিকে তাই বস্তুর নিজস্ব গুণ রূপে স্বীকার করা হয়। অর্থাৎ, বলা যায় যে, বস্তুর গুণগুলি হল অবশ্যই বস্তুগত। এগুলি তাই কখনোই বস্তুর উপর জ্ঞাতার মনের আরোপ নয়। বস্তুর গুণ বস্তুতে থাকে বলেই বস্তু অনুযায়ী আমাদের তার জ্ঞান হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আতার মনের কোনো ভূমিকাই থাকে না। বস্তুর গুণগুলি আমাদের চেতনায় সরাসরিভাবে ধরা দেয়। আমাদের চেতনা হল এক সম্মানী আলোর (Search light) মতো, যা ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে বস্তুকে আলোকিত করে এবং বস্তুর গুণগুলিকে সরাসরিভাবে জানতে পারে। সরল বস্তুবাদের জ্ঞান হল তাই একপ্রকার প্রত্যক্ষ বা সরাসরিভাবে পাওয়া যথার্থ বস্তুজ্ঞান। সরল বস্তুবাদের মূল বক্তব্যকে নীচের সূত্রগুলির মাধ্যমে উপস্থিাপিত করা যায়—

 

বৈচিত্রপূৰ্ণ ৰস্তুতে বাহ্যজগত: 

 

 আমাদের মনোজগতের বাইরে যে বাহ্যজগত আছে তা অসংখ্য বস্তুতে পূর্ণ, যেমন গাছপালা, ঘরবাড়ি, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি। এই সমস্ত বস্তুগুলির ধর্মও ভিন্ন ভিন্ন এবং সেগুলি অবশ্যই বস্তুতেই অবস্থান করে। এরূপ বিভিন্ন ধর্মযুক্ত বস্তুগুলিই হল আমাদের জ্ঞানের বিষয়।

 

বাহাজগতের বস্তুগুলির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থান: 

 

 বাহ্যজগতের বিভিন্ন বস্তুগুলি অবশ্যই আমাদের মননিরপেক্ষ। অর্থাৎ, এগুলির অবস্থান কখনোই আমাদের মনের ওপর নির্ভর করে না। সেগুলির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। আমরা সেগুলিকে প্রত্যক্ষ করি বা না করি, সেগুলির অস্তিত্ব থেকেই যায় এবং কারো না কারোর জ্ঞানের বিষয় রূপে গণ্য হয়।

 

বাহ্যবস্তুর জ্ঞান হল প্রত্যক্ষ জ্ঞান:

 

  বাহ্যবস্তুর জ্ঞান আমরা সবসময়ই প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরিভাবে পেয়ে থাকি। এই বাহ্যবস্তুর জ্ঞানের জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর মধ্যে কোমে মাধ্যম থাকে না।

 

জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বাহ্যবস্তুর সম্পর্ক হল বাহ্যিক: 

 

 জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কটি হল একেবারেই বাহ্যিক। সেকারণেই দাবি কার যায় যে, জ্ঞাতাকে বাদ দিয়েও বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর বাহ্যসম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে গেলেও বস্তুর অস্তিত্বের কোনো হানি ঘটে না। বস্তুগুলি তাই মন-নিরপেক্ষ বাহ্য জগতে অবস্থান করে।

 

 বাহ্যবস্তুর অবিকল প্রতিলিপি রূপে ধারণা: 

 

 বাহ্যবস্তু থেকেই আমাদের বস্তু ধারণা উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ, বাহ্যবস্তু সম্পর্কে আমাদের যে সাক্ষাৎ অনুভব হয়, তা বাহ্যবস্তুর দ্বারাই সৃষ্ট। বাহ্যবস্তু না থাকলে তাই আমাদের কোনো সাক্ষাৎ অনুভবই সম্ভব নয়। যেমন, কোনো টেবিলের অস্তিত্ব না থাকলে তার সাক্ষাৎ অনুভবও সম্ভব নয়।

 

 বাহ্যবস্তুর জ্ঞান হল বস্তু স্বরূপকেন্দ্রিক:

 

  আমরা আমাদের চেতনায় বাহ্যবস্তুর যে জ্ঞান লাভ করি, তা তার স্বরূপকেই প্রকাশ করে। অর্থাৎ, আমাদের সমস্ত প্রকার বাহ্যবস্তুর জ্ঞান হল বস্তুর স্বরূপকেন্দ্রিক। এর অর্থ হল— বাহ্যবস্তুটি ঠিক যেরকম, আমরা ঠিক সেই রকমই জ্ঞান পেয়ে থাকি। বাহ্যবস্তুর স্বরূপের অতিরিক্ত কোনো জ্ঞান আমাদের চেতনায় ধরা দেয় না।

 

সরল বস্তুবাদের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য:

 

সরল বস্তুবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল—

 

সাধারণ লোকের মতবাদ হিসেবে সরল বস্তুবাদ:

  সাধারণ মানুষের সহজ ও সরল বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই সরল বস্তুবাদের ধারণাটি গড়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ (common people) বিশ্বাস করে যে, আমরা যে জগতে বসবাস করি, সেই জগৎ হল অসংখ্য বস্তুসমন্বয়ে গঠিত এক বিচিত্র জগৎ। এই সমস্ত বস্তু হল ভৌত বস্তু (physical object)। এর উদাহরণ হল—গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, নদনদী, ঘরবাড়ি ইত্যাদি। এই সমস্ত বস্তুর স্বরূপ কোনোভাবেই জ্ঞাতার মনের ওপর নির্ভর করে না। এগুলির স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র সত্তা আছে। অতীতেও এদের অস্তিত্ব ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

 

সাক্ষাৎ প্রতীতিবাদ হিসেবে সরল বস্তুবাদ:

  সরল বস্তুবাদ অনুসারে আরও স্বীকার করা যায় যে, আমরা বাহ্যিক ভৌত বস্তুসমূহকে সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষ করি এবং এরূপ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে আমরা সেই সমস্ত বস্তু সম্পর্কে সোজাসুজি জ্ঞান লাভ করি। এর মূল কথা হল—

 

বস্তু যেমন তেমন জ্ঞানলাভ : বাহ্যবস্তু ঠিক যেমন, আমরা ঠিক তেমনভাবেই বস্তুটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। কারণ, প্রত্যক্ষের প্রভাবে বাহ্য বস্তুটির চরিত্রের কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। ফলে, বাহ্যবস্তু সম্পর্কে আমাদের যে ধারণাটি গঠিত হয়, তা বস্তুটির নিজস্ব স্বরূপ অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বস্তুর কোনো প্রতিলিপি (copy)-র মাধ্যমে আমাদের বস্তু সম্বন্ধীয় জ্ঞানলাভ হয় না। ফলে, জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয়ের মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিরূপের কোনো ভূমিকাই নেই।

 

সরাসরি গুণসমূহ প্রত্যক্ষ : বাহ্যবস্তুগুলি যেমন সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষযোগ্য হয় তেমন তার গুণসমূহও আমাদের কাছে সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষযোগ্য হয়। এ যেন ঠিক মনের সন্ধানী আলোক (search light) স্বরূপ, যা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে। আলোক যেমন তার লক্ষ্যবস্তুকে (বাহ্যবস্তুকে) যথাযথভাবে অস্তিত্বশীল করে তোলে, আমাদের মনের চেতনাও তেমনি বাহ্যবস্তুর ধর্মসমূহকে যথাযথভাবে উদ্ভাসিত করে তোলে। সরল বস্তুবাদকে তাই অনেকে ‘সাক্ষাৎ প্রতীতিবাদ’ (immediate cognition)রূপেও অভিহিত করেছেন। আবার অনেকে একে প্রাচীন বস্তুবাদও বলেছেন। কারণ বস্তুবাদের এরূপ ধারণাটি প্রথম থেকেই প্রকাশিত।

 

সরল বস্তুবাদের সমালোচনা :

 

সরল বস্তুবাদ সরলরূপে প্রতিফলিত হলেও এই মতবাদকে নীচে উল্লিখিত কারণগুলির জন্য গ্রহণ করা যায় না।

 

ভ্রান্ত জ্ঞানের ব্যাখ্যায় অপারগ: 

 এই মতবাদের বিরুদ্ধে প্রথম এবং প্রধান যে অভিযোগ আনা যায় তা হল এটি ভ্রান্ত জ্ঞানের ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। প্রাত্যহিক জীবনে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত জ্ঞান অবশ্যম্ভাবী। কারণ, কোনো কোনো সময় বস্তুর প্রত্যক্ষ জ্ঞান যেমন যথার্থরূপে প্রতিভাত হয়, তেমনি কোনো কোনো সময় ভ্রান্ত জ্ঞানেরও উদ্রেক হয়। এরূপ ভ্রান্ত জ্ঞানের উদ্রেক হয় বলেই আমরা সর্পে রজ্জু প্রত্যক্ষ করি; বৃক্ষের কাণ্ডকে মানুষ বলে ভুল করি। আবার স্বপ্নে যে সমস্ত বস্তু আমরা দেখি, সেগুলিও ভুল বলে বিবেচিত। এই সমস্ত ভুলের ব্যাখ্যা সরল বস্তুবাদ আমাদের দিতে পারে না। সে কারণেই, সরল বস্তুবাদ একটি একপেশে মতবাদরূপে পরিগণিত হয়েছে।

 

অমূল প্রত্যক্ষের ব্যাখ্যায় অক্ষম:

 

 প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় যে, আমাদের অমূল প্রত্যক্ষ (hallucination) ঘটে। কিন্তু এই সমস্ত অমূল প্রত্যক্ষের পিছনে কোনো বস্তুই প্রকৃতপক্ষে থাকে না। অধ্যাসের (illusion) ক্ষেত্রে একটা বস্তু থাকে বটে, কিন্তু আমরা বস্তুটির প্রকৃত স্বরূপ বা রূপকে প্রত্যক্ষ না করে, তাকে বিকৃতভাবে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু অমূল প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে বিকৃত বা অবিকৃত কোনো ধরনের বস্তুই থাকে না। ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করার পরিপ্রেক্ষিতে শূন্যে ভেসে বেড়ানো যে ছুরিটিকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তা একটি অমূল প্রত্যক্ষের উদাহরণ। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যক্ষ বা জ্ঞান কীভাবে হয়, সরল বস্তুবাদ তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে না।

 

 প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুগুলির পরিবর্তনশীলতা:

 

 সরল বস্তুবাদ যে স্থান, কাল এবং পাত্রভেদে বিভ্রান্তিকর, সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। কোনো প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুকে কেউ বড়ো দেখে আবার কেউ ছোটো দেখে। অনেকের কাছে কোনো বস্তু ভারী মনে হলেও, তা আবার অনেকের কাছে হালকা বলেও মনে হয়। তাই যদি সত্য হয়, তাহলে কী করে সরল বস্তুবাদ অনুযায়ী স্বীকার করা সংগত যে, বস্তুর গুণগুলি একান্তভাবেই বস্তুগত? বস্তুর গুণ যদি বস্তুগতরূপে স্বীকার্য হয়, তাহলে বস্তুজ্ঞানের ক্ষেত্রে এধরনের বিভেদমূলক প্রত্যক্ষ সম্ভব হত না। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এরূপ বিভেদমূলক প্রত্যক্ষ সম্ভব হয় বলে সরল বস্তুবাদীদের বক্তব্য কখনোই গ্রাহ্য হতে পারে না।

 

আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা অস্বীকৃত : 

 

আধুনিক কালের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এটি প্রমাণিত যে, আমাদের বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান পুরোপুরিভাবে বস্তুর গুণধর্মের প্রত্যক্ষের ওপরই নির্ভরশীল নয়। বহুলাংশে তা আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের গঠন প্রকৃতি এবং তার সামর্থ্যের ওপরও নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, চক্ষুর স্বতন্ত্র গঠন এবং সামর্থ্যজনিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মৌমাছি অতিবেগুনি রশ্মিও দেখতে পায়। কিন্তু আমাদের পক্ষে তা দেখা সম্ভব নয়। কাজেই সমস্ত প্রাণীই একটি বস্তুতে একই ধর্মকে দেখতে পায়, এমন নয়। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, বস্তুর ধর্ম বা গুণ বস্তুর মধ্যেই থাকে—এ দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।

 

একই বস্তুতে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের প্রত্যক্ষণ:

 

 সবশেষে বলা যায় যে, আমরা অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন গুণকে একই বস্তুতে দেখি। আমরা ঠিক যেমন দেখতে, সেরকমই দেখব, যদি আমাদের সামনের আয়নাটি সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিহীন হয়। কিন্তু ত্রুটিযুক্ত আয়নায় আমরা প্রকৃত রূপকে না দেখে, বিকৃত রূপকেই দেখি। স্বাভাবিক পরিণতিতে মোটা ব্যক্তিকে রোগা হিসেবে এবং রোগাকে মোটা হিসেবে, লম্বা ব্যক্তিকে বেঁটে হিসেবে এবং বেঁটে ব্যক্তিকে লম্বারূপে দেখি। আকাশ সব সময়ই পৃথিবীর ওপরে থাকে। কিন্তু আমরা যদি দিক্‌চক্রবালের দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের চোখে ধরা পড়ে যে, সেই আকাশ মাটিতে এসে মিশেছে। সুতরাং, একই বস্তুতে ভিন্ন ভিন্ন গুণের সমাবেশ কেন ঘটে, তার ব্যাখ্যা সরল বস্তুবাদ দিতে পারে না। এই সমস্ত কারণেই সরল বস্তুবাদ আমাদের কাছে একটি ত্রুটিহীন এবং গ্রহণযোগ্য দার্শনিক মতবাদরূপে গণ্য হতে পারে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *