সাজাহান নাটকের প্রশ্ন উত্তর নায়ক চরিত্র আলোচনা টেকজ সঞ্জীব
সাজাহান নাটকের প্রশ্ন উত্তর নায়ক চরিত্র আলোচনা টেকজ সঞ্জীব
সাজাহান নাটকের নায়ক চরিত্র
প্রশ্ন ।। দারা, সাজাহান অথবা ঔরংজীব কাহাকে সাজাহান নাটকের নায়ক বলা যাইবে তাহা যুক্তিসহ আলােচনা কর।
অথবা,
সাজাহান’ নাটকে নায়ক কে ? তােমার বক্তব্য যুক্তিসহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা,
‘সাজাহান’অথবা ঔরংজীব কাকে ‘সাজাহান’ নাটকের নায়ক বলা যেতে পারে যুক্তিসহ আলােচনা কর।
সাজাহান নাটকের নায়ক চরিত্র
উত্তর। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল তার ঐতিহাসিক নাটক সাজাহান’-এর চরিত্রগুলি সন্নিবেশিত করেছেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেই। মােগল সম্রাট সাজাহানের জীবনের শেষ আট বছরের যে বিয়ােগান্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল নাটকের কাহিনীর মুখ্য ঘটনা তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। আর সেই কাহিনীকে পরিণতি দান করেছে যে সমস্ত প্রধান চরিত্র তাদের মধ্যে সম্রাট সাজাহান নিজে এবং তার দুই পুত্র দারা ও ঔরংজীব প্রধানতঃ উল্লেখযােগ্য। কিন্তু নাটক যেহেতু কতকগুলি দৃশ্যের উদ্দেশ্যহীন এবং বিশৃঙ্খল উপস্থাপনা মাত্র নয় সেহেতু নাটকের কাহিনী একটি সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে আদি-মধ্যস্তরের মধ্য দিয়ে পরিণতিতে গিয়ে পৌঁছায়। এখানে সাজাহান’ নাটকের কাহিনীতেও বৃদ্ধ, কর্মক্ষমতাহীন সম্রাট সাজাহানের নিষ্ক্রিয়তার সুযােগে তাঁর পুত্রেরা সিংহাসন লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পর দ্বন্দ্বসংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। সেখানে সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা ও তৃতীয় পুত্র ঔরংজীব এই দুই প্রবল প্রতিপক্ষের মধ্যে যে সংঘর্ষ বেধেছিল এবং সেই সংঘর্ষের করুণ পরিণতির সাক্ষী হিসাবে বৃদ্ধ সাজাহান সম্রাটের ছায়া-স্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন।
এখানে নাট্যকার যে চরিত্রটি অবলম্বন করে তার মূল বক্তব্যকে রূপায়িত করেন তিনিই নাটকে নায়কের মর্যাদা লাভ করে থাকেন। অর্থাৎ নাটকের মূল অভিপ্রায় ও প্রতিপাদ্য বিষয় যে চরিত্রকে অবলম্বন করে উপস্থাপিত হয়, তিনিই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বিবেচিত হন। দ্বিজেন্দ্রলালের সাজাহান’ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের স্বীকৃতি কার প্রাপ্য সেটাই আমাদের এখন বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে।
সাজাহান নাটকের নায়ক কে
‘সাজাহান’ নাটকের নায়ক কে, এনিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। সুতরাং নায়ক চরিত্র নির্বাচনে বিভিন্ন মতগুলির সতর্ক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
সর্বাগ্রে দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনীকার নবকৃষ্ণ ঘােষ মহাশয়ের বক্তব্য এখানে স্মরণীয়। তার মতে দারাই নাটকের নায়কের আসনে বসার অধিকারী। কারণ দারার মৃত্যুই ‘সাজাহান’ নাটকের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। তাই তিনি বলেন, “দারার জীবনাবসানের সঙ্গেই নাটকের যবনিকাপাত হওয়া উচিত ছিল। সাজাহান বিদ্রোহের পূর্বে যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থাতেই আগ্রার দুর্গপ্রাসাদে ভােগসুখে রহিলেন। দারা সিংহাসন ও জীবন দুই-ই হারাইলেন। প্রকৃতপক্ষে তাহার ভাগ্যবিপর্যের উপরেই নাটকের ভিত্তি স্থাপিত এবং তাহার ঘটনায় মন এরূপ অবসাদগ্রস্ত হয় যে নাট্যকারের প্রভূত গুণপনা থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী দৃশ্যগুলি অবহিত হইবার আর ধৈর্য থাকে না।”
এই বক্তব্য অনুসারে যদিও দারার মৃত্যু নাটকের সর্বাপেক্ষা বিষাদময় ঘটনা হিসাবে দারার ট্র্যাজেডিকে মুখ্য করে দেখানাে হয়েছে, কিন্তু দারার মৃত্যু একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে গণ্য হতে পারে না। তাছাড়া একটা মহৎ ব্যক্তিত্বের পতনে যে হাহাকার ধ্বনিত হয় তারও প্রতিফলন নাটকে পরিলক্ষিত হয় না। তার জন্য যে শৌর্য ও বীর্যের অধিকারী হতে হয় তাও দারার করায়ত্ব নয়। তার ফলে সে কোন প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তুলতেও সমর্থ হয় না। এই সমস্ত কারণে কেবলমাত্র বেদনাদায়ক মৃত্যুকে মূলধন করে তাকে নায়কের মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
সাজাহান’ নাটকে নায়ক
আবার এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত নাট্যসমালােচক ডঃ অজিত কুমার ঘােষের অভিমত হল— “প্রকৃতপক্ষে যিনি কাহিনীর মধ্যস্থলে বিরাজ করিয়া সমস্ত চরিত্রকে নিয়ন্ত্রিত এবং নিয়মিত করিয়াছেন, তিনি ঔরংজীব”। কাজেই তার মতে ঔরংজীব এই নাটকের সর্বাপেক্ষা প্রধান এবং প্রভাবশালী চরিত্র। এ কথা সত্য যে, ঔরংজীব এই নাটকে অত্যন্ত সক্রিয়, এবং সাজাহান, দারা, সুজা, মােরাদ—এতগুলি শক্তিশালী ব্যক্তির জীবনের শােচনীয় বিপর্যয় এই ঔরংজীবের দ্বারাই ঘটেছে। কিন্তু তবুও একবাক্যে ঔরংজীবকে এই নাটকের নায়ক চরিত্র বলে স্বীকার করা যায় না। কারণ যদিও ঔরংজীবের কূটবুদ্ধি ও চক্রান্ত তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে সাফল্য লাভ করেছে এবং অবশেষে পিতার কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করেছেন। তার এই ক্ষমাপ্রার্থনা বা বিবেকদংশনের চিত্র পাঠকের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগ্রত করে না। তার চরিত্র নিষ্ঠুরতা ও লােভীর পরিচয় বহন করে। তাছাড়া তাঁর ধর্মের ভন্ডামি তাকে কোন আদর্শ চরিত্রের পটভূমিকায় প্রতিস্থাপিত করে নি। সেজন্য কেবলমাত্র সক্রিয়তাই তাকে নায়ক চরিত্রের মর্যাদা দান করতে পারে না।
এখন সাজাহান’ নাটকটি ট্র্যাজেডি নাটকের পৰ্য্যায়ভুক্ত ধরে নিলে নাট্যকারের মূল অভিপ্রায় কী সেটা অনুধাবন করা দরকার। অর্থাৎ নাট্যকারের মূল অভিপ্রায় যে চরিত্রকে অবলম্বন করে উপস্থাপিত হয়, তিনিই নাটকের নায়ক তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র।
নায়ক চরিত্র
প্রকৃতপক্ষে নাট্যকার আলােচ্য নাটকে যে মূল বক্তব্য রূপায়িত করেছেন, তাঁর অবলম্বন সাজাহান। পিতৃসত্তা এবং সম্রাটসত্তার অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলেই সাজাহানের জীবনে নেমে এসেছে মর্মান্তিক বিপর্যয়। আর এই বিপর্যয় ঘটেছে সাজাহানের প্রকৃত ভুলের জন্যই। অন্যান্য পুত্রদের বিদ্রোহ দমনের জন্য দারাকে সৈন্য প্রেরণের নির্দেশ দিয়ে তিনি সম্রাটের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তার পরিণামের কথা চিন্তা করে অন্তরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। পুত্রদের প্রতি স্নেহাতিশয্যের জন্যই আপন বন্দীদশা ; দারা, সুজা, মােরাদ-এর মৃত্যুর যন্ত্রনা পিতা সাজাহানকেই ভােগ করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন—সাজাহানের অন্তর্দ্বন্দ্বই এই নাটকের দ্বন্দ্ব, তাহার জীবনের করুণ পরিণতিই ইহার ট্র্যাজেডি।…সাজাহান বৃদ্ধাবস্থায় অসুস্থ ও পুত্রের হস্তে বন্দীভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করিয়াছেন সত্য, কিন্তু সেই অবস্থায় বৃদ্ধের বুক চিরিয়া হৃদয়টি খুলিয়া দেখিবার যদি কোন উপায় থাকিত, তাহা হইলে দেখা যাইত যে তাহার উপর দিয়া কুরুক্ষেত্রের মহাসমর সংঘটিত হইতেছে। নৈরাশ্যে, অপমানে, বেদনায়, শােকে, অবসাদে, স্নেহে, গৌরবে, বিশ্বাসে প্রতি মুহূর্তে তাঁহার সচেতন মনের যে বিচিত্র উত্থান ও পতনের কাহিনী এই নাটকে বর্ণিত হইয়াছে, তাহাতে সার্থক নাটকীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হইয়াছে।” তাই একথা স্বীকার করতেই হয় যে সাজাহানের ট্র্যাজেডি প্রদর্শনই নাট্যকারের মূল অভিপ্রায় ছিল। সুতরাং এই নাটকের নায়ক হিসাবে সাজাহানকেই যােগ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত।