সাজাহান নাটকের জাহানারা চরিত্র আলোচনা টেকজ সঞ্জীব
সাজাহান নাটকের জাহানারা চরিত্র আলোচনা টেকজ সঞ্জীব
জাহানারা চরিত্র
প্রশ্ন।। জাহানারা চরিত্রটি বিশ্লেষণ করে চরিত্রটির নাটকীয় উপযােগিতা বিচার কর।
অথবা,
‘সাজাহান’ নাটকে জাহানারা চরিত্রটিকে কি কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদা দেওয়া যায় ? চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলােচনা করে এই বিষয়ে তােমার অভিমত ব্যক্ত কর।
অথবা,
কেউ কেউ মনে করেন সাজাহান’ নাটকের নামকরণ ‘জাহানারা’ হলেও ক্ষতি ছিল না—জাহানারা চরিত্র বিশ্লেষণ পূৰ্ব্বক এ সম্পর্কে তােমার অভিমত লিপিবদ্ধ কর।
অথবা,
‘সাজাহান’ নাটকে জাহানারা চরিত্রের সামগ্রিক বিশ্লেষণে চরিত্রটির নাটকীয় গুরুত্ব বিচার কর।
উত্তর। সাজাহান’ নাটকের প্রধান চরিত্রগুলাের মধ্যে জাহানারা চরিত্রটি অন্যতম। এই নাটকের নারীচরিত্রগুলাের মধ্যে তাে বটেই এমন কি স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র নাটকে সবগুলাে চরিত্রের মধ্যে জাহানারার একটি বিশেষ স্থান আছে। ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতায়, যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপনায়, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে, আবেগের উচ্ছাসে, কঠোরতায়-কোমলতায় জাহানারা চরিত্রটি প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শকদের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জাহানারার এই ভূমিকার জন্য কোন কোন সমালােচক জাহানারা নামে সাজাহান’ নাটকের নামকরণ সমর্থন করেছেন। আবার অনেকে তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে মর্যাদা দান করতেও কুণ্ঠা বােধ করেন নি। এখন তার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করে উপরােক্ত অভিমতগুলির যাথার্থ্য আমাদের বিচার বিবেচনা কবে দেখতে হবে।
জাহানারা চরিত্রাঙ্কনে নাট্যকার ইতিহাসকে যথাযথভাবেই অনুসরণ করেছে। ইতিহাসে আরা জাহানারাকে বলিষ্ঠ, তেজস্বিনী নারীর ভূমিকায় দেখি। দিল্লীর সিংহাসন দখলের সং গ্রামে, সাজাহানের পুত্রদের মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, হীন জঘন্য ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত, নিষ্ঠুর বীভৎস হত্যার রাজনীতি, বৃদ্ধ সম্রাট সাজাহানের করুণ বিলাপ ও আর্তনাদের মধ্যে জাহানারা বে সক্রিয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, তা অবশ্যই বিস্ময়কর এবং প্রশংসনীয়। পিতাকে বন্দ করে ঔরংজীব সিংহাসন অধিকার করে নিজেকে সম্রাটরূপে ঘােষণা করেছিলেন। জাহানারা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছেন। আর একদিকে বৃদ্ধ, অসুস্থ বন্দী পিতা সম্রাট সাজাহানের পাশে সেবাপরায়ণা কন্যারূপে প্রকৃত কর্তব্যকর্ম করেছেন।
সাজাহান নাটক
নাটকে আমরা জাহানারাকে পেয়েছি দারার সমর্থকরূপে। এ সমর্থন নিছক আবেগতাড়িত নয়। পিতৃ সিংহাসনে জ্যেষ্ঠভ্রাতার অধিকার যেমন যুক্তিনিষ্ঠ, তেমনি পিতা বর্তমানে অন্যান্য পিতাকে অগ্রাহ্য করে ঔরংজীবের স্বেচ্ছাচারিতাকে তিনি মােটেই সহ্য করেন নি। যে বলিষ্ঠতর সঙ্গে তিনি তার বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন, তা সম্রাটকন্যারই উপযুক্ত। তাই কোন অবস্থাতেই জাহানারা নিজের তেজস্বিতাকে বিসর্জন দেন নি। সাজাহান যখন বলেছেন, তিনি বিদ্রোহী পুত্রদের স্নেহের শাসনে বশ করবেন, জাহানারা পিতার এই স্নেহাতিশব্যকে দুর্বলতা বলে মনে করেছে। তিনি দীপ্ত রােষে জ্বলে উঠে বলেন,—“পুত্র কি কেবল পিতর স্নেহের অধিকারী? পুত্রকে শাসনও করতে হবে। আবার যুক্তিযুক্তভাবে বলে উঠ, সাম্রাজ্য কি অন্তঃপুর! একটা ছেলেখেলা!.প্রজা বিদ্রোহী হলে সম্রাট কি তাকে পুত্র বলে ক্ষমা করবেন? স্নেহ কি কর্তব্যকে ছাপিয়ে উঠবে? এভাবে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের কলুষতার মধ্যে নিতে না জড়িরেও ন্যায় ও সত্যের যুক্তিনিষ্ঠ পথ ধরে এগিয়ে গেছেন। এটা তার চরিত্রের বলিষ্ঠতবই পরিচায়ক।
সাজাহান নাটক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জাহানারা
চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ন্যায়নিষ্ঠার বলেই জাহানারা বারবার পিতা সাজাহান ও দারাকে কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছে। এমনকি ভ্রাতৃবধূ নাদিরা যখন ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের পরিণাম সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে স্বামীকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেছে, তখন জাহানারা তাকে ধিক্কার দিয়ে সচকিত করেছে, তীক্ষ ভাষায় তিরস্কার করেছে, নাদিরা তুমি পরভেজের কন্যা না? একটা যুদ্ধের ভয়ে অশ্রু, এই শঙ্কাকুল দৃষ্টি, এই ভয়বিহুল উক্তি তোমার শোভা পায় না। তার পিতা সাজাহানকে জাহানারা সব সময়ই প্রেরণা দিয়ে উদ্দীপ্ত করতে চেষ্টা করেছেন। পুত্রদের বিদ্রোহে, ঔরংজীবের বিশ্বাসঘাতকতা এবং কৃতঘ্নতায় যখন সাজাহান বিপর্যস্ত ও বিলাপরত, তখন দীপ্ত ভাষায় জাহানারা পিতাকে কর্তব্যবােধে জাগ্রত করেছে,—এই কারাগারের কোণে বসে অসহায় শিশুর মত ক্রন্দন করলে কিছু হবে না,…পাপী মুমূর্ষুর মত অন্তিমে একবার ঈশ্বরকে দয়াময়’বলে ডাকলে কিছু হবে না। উঠুন, দলিত ভুজঙ্গের মত ফণা বিস্তার করে উঠুন, হৃতশাবক ব্যাঘ্রীর মত প্রমত্ত বিক্রমে গর্জে উঠুন।
সাজাহান নাটক প্রশ্ন উত্তর
শত বিপর্যয়ের মধ্যেও জাহানারা কখনাে কাতরতা প্রকাশ করে আবেদন-নিবেদনের অবমাননাকারীর পথ অনুসরণ করেন নি। অবশ্য জাহানারার ঋজু পথ ধরে অগ্রগমন যত বলিষ্ঠই হােক, ঔরংজীবের কুটিল চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন করে জাহানারা শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। রাজসভা মাঝে জাহানারা নির্ভীকতা ও বলিষ্ঠতার সঙ্গে যে বক্তব্য পেশ করেছেন ঔরংজীবের শঠতা ও ভন্ডামির কাছে তা প্রতিহত হয়েছে। কিন্তু সাময়িক পরাজয় ঘটলেও জাহানারা তাতে বিভ্রান্ত না হয়ে ঔরংজীবের শঠতা ও ভন্ডামিকে সহজেই অনুধাবন করতে পেরেছে। এই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিশক্তি জাহানারা লাভ করেছেন তার এই সত্যপথের প্রতি নিষ্ঠার জন্য। এখানে জাহানারার শুধু দৃঢ়তাই প্রকাশ পায় নি। তার বাকপটুতা সহজেই সম্রাট কন্যার মননশীলতার ইঙ্গিত বহন করে। তাঁর নিঃস্বার্থ কর্তব্যবােধকে বারবার প্রকাশ করে, জাহানারা সম্রাটকন্যার মহিমা নিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছেন।
জাহানারা চরিত্রের আর একটা বিশেষ দিক হল অসুস্থ পিতার জন্য আন্তরিকভাবে সেবাপরায়ণ হওয়া। একাধারে স্নেহ ও ভক্তি দিয়েই জাহানারা সাজাহানকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করতেন। এই সেবার জন্যই সাজাহান মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেও সম্পূর্ণ বিকৃত-মস্তিষ্ক হয়ে পড়েন নি। জাহানারা অবিবাহিতা ছিলেন বলেই তার হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ-প্রেম সাজাহানের সেবায় প্রযুক্ত হয়েছিল। জাহানারার ওপর পরম নির্ভরতা জাহানারার স্নেহকে আরও উদ্দীপ্ত করে তুলেছে। তাই সমস্ত বিপর্যয়ের প্রথম ধাক্কা নিজ দেহে বহন করে জাহানারা যেন আঘাতের তীব্রতাকে প্রশমিত করে তা সাজাহানের কর্ণগােচর করেছেন।
সাজাহান নাটক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জাহানারা চরিত্র
জাহানারা চরিত্রের এই অতি তৎপরতা ও ঔজ্জ্বল্যের দিকে তাকিয়ে অনেকে জাহানারাকে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু আমাদের বক্তব্য হল আলােচ্য নাটকের কেন্দ্রীয় ঘটনাটি অর্থাৎ ঔরংজীবের সিংহাসন লাভ আদৌ তার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ঔরংজীবকে তিনি মাঝে মাঝে কিছুটা অসুবিধায় ফেলতে চেষ্টা করলেও, তার প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল টপকে যেতে ঔরংজীবকে বিশেষ বেগ পেতে হয় নি। তা ছাড়া জাহানারা চরিত্রের তেজস্বিতা, বলিষ্ঠতা, নির্ভীকতা এবং স্নেহময়ীর সেবাপরায়ণতা এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করলেও জাহানারাকে নাটকের কেন্দ্রীয় চবিত্রের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ জাহানারার দুঃখ-দুর্ভাগ্য এই নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। এই নাটকে সাজাহানের জীবনের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সকল ঘটনাই নাট্যকার মুখ্যতঃ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নাট্যকাহিনীর একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত বিদ্রোহী পুত্রদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণের অনুমতি প্রদানের ঘটনা থেকে আরম্ভ করে, দিল্লীর সিংহাসন দখলের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, নানা কূট চক্রান্ত, নিষ্ঠুর বীভৎস হত্যার রাজনীতি, অপরদিকে বৃদ্ধ পিতা সম্রাট
সাজাহানের বন্দী হওয়া এবং পরিশেষে সাজাহানের অর্ধেন্মাদ অবস্থায় করুণ বিলাপরত পিতার সাথে থেকে জাহানারা যে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, তা অবশ্যই বিস্ময়কর ও প্রশংসনীয়। একদিকে যেমন অন্যায়ভাবে ঔরংজীবের সিংহাসন অধিকারের ঘটনার অন্যদিকে, পিতার প্রতি তার অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন জাহানারা। নাটকে জাহানারার প্রাধান্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এইখানেই।
এখন নাটকে জাহানারা চরিত্রের উপযােগিতা কতখানি, সে প্রসঙ্গে আলােচনা করে দেখা দরকার। ‘সাজাহান’ নাটকের সাজাহানের সম্রাটসত্তা ও পিতৃসত্তার দ্বন্দ্ব এবং পরিণতিতে পিতৃসত্তার জয় ঘােষণা করাই নাট্যকারের প্রতিপাদ্য বিষয়। সম্রাট সাজাহানের পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে একটা বিষাক্ত আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জাহানারা এই পরিবেশে ও আবহাওয়ার মধ্যে একটি স্নিগ্ধ, সুন্দর ও কোমল চরিত্র। জাহানারা মমতাময়ী কন্যারূপে পিতা সাজাহানকে সেবা করেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, উদ্দীপ্ত করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে।
সাজাহান নাটক জাহানারা
জাহানারা চরিত্রের আর একটি উপযােগিতা আছে সেটা আদর্শগত। আদর্শের প্রতি কতখানি নিষ্ঠা থাকলে তেজস্বিনী, দৃঢ়চিত্ত ও নির্ভীক হওয়া যায় তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন নাট্যকার জাহানারার মাধ্যমে। তিনি ঔরংজীবের চক্রান্ত, নৃশংসতা, বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ করেছেন, এমন কি অন্তঃপুরচারিনী নারী হয়েও প্রকাশ্য দরবারে সকলের সামনে ঔরংজীবকে অভিযুক্ত করেছেন। কর্তব্যবােধের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সংসারে নারীর স্থান, ভূমিকা ও আদর্শকেই নাট্যকার জাহানারা চরিত্রকে আশ্রয় করে মূর্ত করে তুলেছে। জাহানারার সক্রিয় ভূমিকা যথেষ্ট, কিন্তু তা প্রত্যক্ষভাবে ঘটনার অগ্রগতিকে সাহায্য না করলেও সংসারে কন্যা, ভগিনী প্রভৃতি বিভিন্ন নারীসত্তার প্রকাশ তার মধ্যে ঘটেছে। আর জাহানারার চরিত্রের উপযােগিতা এইখানেই।