রঞ্জিৎ সিংহের নেতৃত্বে শিখশক্তির অগ্রগতি বর্ণনা কর।
প্রশ্ন ।। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজনৈতিক শক্তিরূপে শিখজাতির অগ্রগতি উল্লেখ কর।
অথবা, রঞ্জিৎ সিংহের নেতৃত্বে শিখশক্তির অগ্রগতি বর্ণনা কর।
অথবা, রঞ্জিৎ সিংহের নেতৃত্বে শিখশক্তির অগ্রগতি বর্ণনা কর। তাহার শাসনব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা,ইংরাজ শক্তির সহিত রণজিৎ সিংহের সম্পর্ক সংক্ষেপে বর্ণনা কর। তাহার মৃত্যুর পর শিখ সাম্রাজ্যের দ্রুত পতনের কারণ কি?
রঞ্জিৎ সিংহের কার্যাবলী পর্যালােচনা কর।
উত্তর। পাঞ্জাবকেশরী রঞ্জিৎ সিংহের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পাঞ্জাবের বহুধাবিভক্ত রাজ্যগুলি একটি ঐক্যবদ্ধ শিখরাজ্যে রূপান্তরিত হয়। এই ঐক্যবদ্ধ শিখরাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্য দিয়া গুরু নানকের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও গুরু গােবিন্দ সিংহের প্রতিষ্ঠিত শিখ সামরিক সংগঠন এক পরিপূর্ণ রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করিল।
পটভূমিকা ঃ
গুরু গােবিন্দ সিংহের নেতৃত্বে গুরু নানকের শিক্ষায় দীক্ষিত শিখসম্প্রদায় যেন পুনর্জন্ম লাভ করিয়াছিল। শক্তিশালী মােগল সম্রাটদের আমলে আপন সত্তা, ধর্ম ও স্বাধীনতা বজায় রাখিবার সংগ্রামে তাহারা তাহাদের নবীন শক্তির পরিচয় দিয়াছিল। অতঃপর মােগল-সাম্রাজ্যের পতন যখন আরম্ভ হইল, নাদির শাহ্ ও আহম্মদ শাহ্ আবদালীর বারবার আক্রমণে শখ অগ্রগতি পাঞ্জাবে যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল তখন শিখগণ তাহার সুযােগ লইতে বিলম্ব করিল না। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলে (১৭৬১ খ্রঃ) মারাঠাশক্তি যখন বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল, উত্তর-ভারতে যখন সুসংহত রাষ্ট্রশক্তির অভাব দেখা দিল, তখন সমগ্র পাঞ্জাব অঞ্চলে শিখদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইবার পথে আর কোন বাধা ছিল না।
১৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দে আহম্মদ শাহ আবদালী ভারত ত্যাগ করিয়া যাইতে বাধ্য হইলে শিখগণরা ওয়ালপিণ্ডি ও যমুনার মধ্যবর্তী সমগ্র অঞ্চল দখল করিল, এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু শিখদের স্বাধীনতা-আন্দোলন সফল হইলেও তাহারা একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করিতে পারিল না এবং দশটি ‘ মিসল’ (Misles) বা দলে বিভক্ত হইয়া পড়িল। এক-একজন দলপতির নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজ্য গঠন করিয়া তাহারা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে লাগিল এবং পরস্পর দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে লিপ্ত হইল। এই মিসলগুলির গঠনপ্রকৃতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক; সুতরাং এক-একটির নিজ রাজ্যে কেন্দ্রীয় শক্তিও ছিল খুব দুর্বল। এই বিভক্ত ও বিবদমান শিখজাতিকে যিনি ঐক্যবদ্ধ করিয়া একটি শক্তিশালী শিখ সাম্রাজ্য গড়িয়াছিলেন তিনিই হইলেন রঞ্জিৎ সিংহ।
রঞ্জিৎ সিংহ : শিখ মিসলগুলির মধ্যে কানহেরা, ভাঙ্গী ও সুকারচুকিয়াএই তিনটিই ছিল। বিশেষ শক্তিশালী। সুকারচুকিয়া ‘ মিস’-এর নায়ক মাহসিংহের বংশে ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে রঞ্জিৎ সিংহ জন্মগ্রহণ করেন। নায়ক মাহসিংহের মৃত্যু হইলে মাত্র ১২ বৎসর বয়সে রঞ্জিৎ সিংহ তাহার ‘মিসল’-এর নায়কপদে অধিষ্ঠিত হন। অতঃপর ১৭ বৎসর বয়স হইতেই তিনি তাহার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। বাম চক্ষুতে তিনি অন্ধ ছিলেন, শিক্ষার সুযােগও তিনি বিশেষ পান নাই; কিন্তু কিশাের বয়সেই সমস্ত শিখজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার সংকল্প তাহার হৃদয়ে উদিত হইয়াছিল।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিখ রাজ্যগুলিকে একত্রিত করিয়া একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করাই ছিল রঞ্জিৎ সিংহের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য বাস্তবে পরিণত করিতে গিয়া তিনি দুইটি বাধার সম্মুখীন হইলেন। একদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিখরাজ্যগুলির মধ্যে অনৈক্য ও আত্মকলহ প্রকট আকার ধারণ করিয়াছিল। অন্যদিকে ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে ব্রিটিশশক্তি সর্বময় প্রভুত্ব স্থাপন করিয়া পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হইতে উদ্যত হইল।
প্রথম পর্যায় ঃ
রঞ্জিৎ সিংহের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যকলাপকে দুইটি পর্যায়ে বিভক্ত রা যায়। প্রথম পর্যায়ে (১৮০৯ খ্রঃ পর্যন্ত) তিনি পাঞ্জাবের খণ্ড খণ্ড রাজ্যগুলিতে নিজ আধিপত্য স্থাপনে ব্যস্ত ছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে সম্পাদিত অমৃত-চুক্তির পর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি শিখরাজ্যকে ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যের অগ্রসর নীতির কবল হইতে মুক্ত করেন।
রণজিৎ সিংহের বজ্যবিস্তার :
১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দ হইতেই রঞ্জিৎ সিংহ তাহার প্রতিবেশী অন্যান্য শিখ মিসল গুলির সহিত যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হইলেন। ১৭৯৮ খ্রীষ্টাব্দে কাবুলের জামান শাহ্ পাঞ্জাব আক্রমণ করিলে এই তরুণ যােদ্ধা মুষ্টিমেয় অশ্বারােহী সৈন্য লইয়া গেরিলা-পদ্ধতিতে তাহাকে বারবার আক্রমণ করিলেন। শেষ পর্যন্ত জামান শাহ রঞ্জিৎ সিংহের সহিত মিত্রতা স্থাপনে বাধ্য হইলেন এবং তাহাকে ‘ রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করিলেন। ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে জামান শাহ্ লাহাের পরিত্যাগ করিয়ে গেলে, রঙিৎ সিংহ লাহােরের উপর তঁাহার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর তিনি নীরওয়াল ও নারওয়াল নামক স্থান দুইটি অধিকার করিয়া জম্মু আক্রমণ করিলেন। জম্মুর রাজা প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণ দিয়া রঞ্জিৎ সিংহের বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ১৮০৫ খ্রীষ্টাব্দে রঞ্জিত সিং অমৃতসর দখল করিলে তাহার শক্তি ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পাইল।
একে একে শতদ্রু নদীর পশ্চিম তীরস্থ প্রায় সমস্ত মিসলগুলির উপরই রঞ্জিৎ সিংহ তাহার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করিতে সক্ষম হইলেন; সমগ্র শিখজাতির মধ্যে তিনি এক নবীন উদ্দীপনার। সৃষ্টি করিলেন। সমগ্র শিখজাতিকে এক বৃহত্তর রাজ্যের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করিবার জন্য শতদ্রর পূর্বতীরস্থ মিসলগুলির জয় করা প্রয়ােজন ছিল। ঠিক এই সময়ে ঐ সমস্ত মিসলগুলির মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিলে কেহ কেহ রঞ্জিৎ সিংহের সাহায্য প্রার্থনা করিল। রঞ্জিৎ সিংহ এই সুযােগে নদী পার হইয়া লুধিয়ানা দখল করিলেন এবং এক শিখরাজ্যে সমস্ত শিখ মিসলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। কিন্তু কোন কোন দলপতি রঞ্জিৎ সিংহের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হইয়া ইংরাজদের সাহায্য প্রার্থনা করিয়া বসিল। এই অনৈক্যের সুযােগ গ্রহণ করিয়া লর্ড মিন্টো চার্লস মেটকাফকে রঞ্জিৎ সিংহের রাজসভায় প্রেরণ করিয়া এই বিষয়ে একটি মিটমাটের প্রস্তাব করিলেন।
দূরদর্শী রঞ্জিৎ সিংহ বুঝিয়াছিলেন যে এককভাবে ইংরাজদের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করা তখন তাহার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি তাহাদের সহিত ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে অমৃতসরের-সন্ধি স্বাক্ষর করিয়া শতদ্রু নদীর পশ্চিম তট পর্যন্ত তাহার রাজ্যসীমা স্বীকার করিয়া লইলেন এবং পূর্ব দিকের মিসলগুলিতে তিনি হস্তক্ষেপ করিবেন না এই প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইহার ফলে ‘অখিল শিখরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা কিছুটা ব্যাহত হইল; ইংরাজদের প্রভাব শতদ্রু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া পড়িল।
দ্বিতীয় পর্যায় (১৮০৯-১৮৩৯ খ্রঃ) : অখণ্ড শিখরাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না হইলেও রঞ্জিৎ সিংহ অমৃতসর চুক্তির পর নিষ্ক্রিয় হইয়া রহিলেন না। এই সময়ে রঞ্জিৎ উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম দিকে রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী হইলেন। পাঞ্জাবের পার্বত্য রাজ্যগুলি জয় করিয়া তিনি কাশ্মীর, মুলতান ও কোহাট জয় করিলেন। অতঃপর তিনি বান্নু, টঙ্ক, ডেরা-ইসমাইল-খান, ডেরা-গাজী-খান, পেশােয়ার প্রভৃতি জয় করিয়া এক বিস্তৃত শিখ-সাম্রাজ্য গড়িয়া তুলিলেন। হিদারুর যুদ্ধে তিনি আফগানদের পরাজিত করিয়া এটক দখল করেন। বারবার আফগান আক্রমণ প্রতিহত করিয়া নিজ রাজ্যসীমা অক্ষুন্ন রাখিতে সক্ষম হন।
তিনি তাহার বিশাল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সফলতার সহিত রক্ষা করিয়াছিলেন। ইংরাজদের সহিত স্বাক্ষরিত অমৃতসরের-সন্ধির শর্তাদি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন। ইংরাজগণও তাহার মৈত্রীর মূল্য উপলব্ধি করিতেন। রুশ ভয়ে ভীত ইংরাজগণ তখন কোনভাবে রঞ্জিৎ সিংহকে অসন্তুষ্ট করিতে চাহে নাই। এমন কি গভর্নর-জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক স্বয়ং রঞ্জিৎ সিংহের দরবারে উপস্থিত হইয়া তাহাকে সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন। রঞ্জিৎ সিংহের জীবদ্দশায় এই মিত্রতা কোন সময় ক্ষুন্ন হয় নাই। বীরবিক্রমে রাজত্ব করিয়া রঞ্জিৎ সিংহ ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
রঞ্জিৎ সিংহের ইঙ্গ-শিখ নীতির মূল্যায়ন:
রঞ্জিৎ সিংহ অনুসৃত সমঝােতার নীতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। ডঃ এন.কে. সিংহ মনে করেন রঞ্জিৎ ব্রিটিশের প্রতি আপােস-মূলক নীতি অনুসরণ করিয়া শিখরাজ্যের বিস্তারের পথ রুদ্ধ। করিয়াছিলেন। ডঃ সিংহ মনে করেন প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের সময় রঞ্জিৎ ব্রিটিশ পক্ষ অবলম্বন করিয়া রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিলেন। ড: সিংহ মনে করেন ইঙ্গ-শিখ চুক্তি দ্বারা ব্রিটিশ পক্ষই বেশি লাভবান হইয়াছিল। ডঃ সিংহ মন্তব্য করিয়াছেন যে এই চুক্তিতে। ব্রিটিশরা ছিল চালক ও রঞ্জিৎ ছিলেন অশ্ব কিন্তু এই সমালােচনা সম্পূর্ণ গ্রহণযােগ্য নয় কারণ রঞ্জিত-এর একার পক্ষে প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশশক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না।
সামরিক সংগঠন : রঞ্জিৎ সিংহ যুদ্ধক্ষেত্রে তাহার সমরকৌশল ও সাহসের যথেষ্ট পরিচয় দিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু সামরিক সংগঠনেও তিনি কম পারদর্শিতার পরিচয় দেন নাই। তাহার রাজ্যের নিরাপত্তা বজায় রাখিতে তিনি অশ্বারােহী বাহিনী ও ‘গেরিলা যুদ্ধনীতিকে কোন সময়েই কম করিয়া দেখেন নাই। কিন্তু তাহার সেনাবাহিনীকে আধুনিক সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করিবার গুরুত্বও তিনি পরিষ্কার উপলব্ধি করিয়াছিলেন।
তিনি নেপােলিয়নের দুইজন প্রাক্তন সামরিক কর্মচারীকে নিজ সেনাবাহিনীর শিক্ষাদানের জন্য নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার সেনাবাহিনী সামরিক দক্ষতায় যে-কোন ইওরােপীয় বাহিনীর সমকক্ষ হইয়া উঠিয়াছিল। মারাঠাদের চাইতে তিনি গােলন্দাজ বাহিনীর গুরুত্ব ভাল বুঝিতেন; এই বাহিনীকে সুসজ্জিত করিবার জন্য কামান প্রস্তুতের নিখুত ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। নানা ইওরােপীয় বীর জাতীয় চরিত্র জাতির লােক তাহার সেনাবাহিনীতে কাজ করিত; কিন্তু তাহাতে ‘খালসা বাহিনীর জাতীয় চরিত্র কিছুই অক্ষুন্ন হয় নাই। সামরিক কর্মচারিদের জায়গীর দেওয়ার পরিবর্তে তিনি নগদ বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; এইরূপভাবে তিনি সরাসরি সৈনিকদের আনুগত্য লাভ করিতেন। এবং বাহিনীর সংহতিকে উন্নত রাখিতেন। এই সমস্তর মধ্য দিয়াই। রঞ্জিৎ সিংহের সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
রঞ্জিৎ সিংহের শাসনব্যবস্থা :
শাসনকার্যেও রঞ্জিৎ সিংহ তাহার দক্ষতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিলেন। তাহার শাসনব্যবস্থা অবশ্য ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা তাহার একক হস্তে সন্নিবদ্ধ ছিল; সে যুগের রীতিই ছিল এইরূপ, কিন্তু তিনি কোন সময়েই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। শিখদের খালসায় যে সহজ গণতন্ত্রের ধারা বজায় ছিল তাহাকে তিনি শ্রদ্ধা করিতেন, প্রচলিত রীতিনীতিকে তিনি অনুসরণ করিতেন।
শাসন ব্যাপারে তিনি ধর্মনির্বিশেষে উপযুক্ত ও প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিকে নিয়ােজিত করিতেন; তাই তিনি তাহার শাসনব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও সুদৃঢ় করিয়া তুলিতে পারিয়াছিলেন; রাজস্বের পরিমাণ তিনি নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন; বণিকদের নিকট হইতে অত্যন্ত নির্বিশেষে উপযুক্ত কর্মচারী নিয়োগ, প্রজাহিতৈষী রাজা নিম্নহারে শুল্ক আদায় করিয়া তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহ দিয়াছিলেন। সুতরাং এক কথায় তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী রাজা।
রঞ্জিৎ সিংহের চরিত্র ও কৃতিত্ব :
ইতিহাসে রঞ্জিৎ সিংহকে ‘পাঞ্জাবকেশরী’ নামে অভিহিত করা হইয়া থাকে; এ আখ্যা অতি সঙ্গতভাবেই তাহাকে দেওয়া হইয়াছে। তিনি নিঃসন্দেহে ভারত ইতিহাসের এক অন্যতম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত শিখজাতির এক বৃহৎ অংশকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করিয়া এক ঐতিহাসিক শক্তিতে পরিণত করিয়াছিলেন। নিজ প্রতিভা, সংগঠনী শক্তি ও সামরিক দক্ষতার বলে তিনি এক সামান্য দলপতি হইতে শিখাজ্যের রাজপদে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন।
বাম চক্ষুতে তিনি ছিলেন অন্ধ, কিন্তু তাহার শরীরে ছিল অসীম বল, স্বাস্থ্য ছিল অটুট এবং কর্মশক্তি ছিল অফুরন্ত। তাহার এই সমস্ত ক্ষমতার পরিচয় যুদ্ধক্ষেত্রে, শাসনব্যাপারে সর্বত্র পাওয়া গিয়াছে, কথিত আছে যে তিনি নিরক্ষর ছিলেন, কিন্তু তাহার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ, সর্ববিষয়ে তাঁহার জ্ঞান ছিল গভীর, তাহার ব্যুৎপত্তি ও অন্তর্দৃষ্টি ছিল সর্বজনবিদিত।
পাশ্চাত্য পর্যবেক্ষকগণ বলিয়াছেন যে তাহার অগ্নিবর্ষী চক্ষু যেন অপরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখিতে পারিত। সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তিনি যেরূপ ক্রমাগত করিয়া যাইতেন, তাহাতে এই নিরক্ষর পাঞ্জাবকেশরীর চিন্তাশক্তি ও ঔৎসুক্য দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। ফরাসী পর্যটক জ্যাকেমো (Jaquemont) তাহাকে নেপােলিয়ন বােনাপার্ট-এর ক্ষুদ্র সংস্করণ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন; তিনি বলিয়াছেন যে রঞ্জিৎ সিংহ ভারতবর্ষ, ইংরাজ, ইওরােপ ও নেপােলিয়ন এবং পুনর্জন্ম, স্বর্গ, মর্ত, নরক, আত্মা, ঈশ্বর, শয়তান সমস্তই বিষয়েই অনর্গল প্রশ্ন করিয়া যাইতেন। লর্ড মিন্টোর দূত চার্লস মেটকা দৌত্যকার্যে কিছুদিন তাহার রাজসভায় অবস্থান করিয়াছিলেন; তিনিও এই মহারথীর বহুমুখী প্রতিভার প্রশংসা করিয়াছেন। দয়া, দাক্ষিণ্য, বিজিতের প্রতি সহানুভূতি ও মর্যাদাবোধ প্রভৃতি গুণের জন্য তিনি সকলেরই প্রশংসা অর্জন করিয়াছেন।
সামরিক ক্ষেত্রে তিনি তাহার সাহস ও নৈপুণ্যের যে পরিচয় দিয়াছেন, তাহার সাংগঠনিক প্রতিভার যে বিকাশ দেখাইয়াছেন তাহাও সকলকে বিস্মিত করে। এই প্রতিভার জোরেই তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলপতিদের এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে পরাভূত করিয়া এক শিখরাজ্য গঠন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। তাহার সামরিক দক্ষতা ও পারদর্শিতার ফলেই তিনি আফগান আক্রমণকে প্রতিহত করিয়া তাহার সাম্রাজ্যে নিরাপত্তা রক্ষা করিয়াছিলেন। শতদ্রুর পূর্ব তীরস্থ শিখদিগকে অবশ্য তিনি ঐক্যবদ্ধ করিতে পারেন নাই।
ইংরাজদের সহিত অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষর করিয়া তাহার অগ্রগতিকে সংযত করিতে হইয়াছিল; ‘অখিল শিখরাজ্যের শতদুর পূর্বদিকের শিখগণের প্রশ্ন স্বপ্ন তিনি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবে রূপায়িত করিতে পারেন নাই। কিন্তু অমৃতসরের-সন্ধি স্বাক্ষর ও তাহার মর্যাদা রক্ষা তঁাহার বাস্তব বুদ্ধিরই পরিচয় দেয়। তিনি বেশ ভালই জানিতেন যে তাহার বর্তমান শক্তিতে এককভাবে ইংরাজদের সহিত সংঘর্ষ সম্ভব নয়, তাহা ছাড়া, শিখদের শৃঙ্খলা ও সংহতি সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে তাহাদের মধ্যে অনৈক্যের ‘বিষ প্রবেশ করিয়াছিল। এক্ষেত্রে তিনি তাহার রাজনৈতিক দূরদর্শিতারও পরিচয় দান করিয়াছিলেন।
শাসনক্ষেত্রেও রঞ্জিৎ সিংহ তাহার প্রতিভার পরিচয় সমভাবে দান করিয়াছিলেন! তাহার প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা স্বৈরাচারী ছিল সত্য, কিন্তু তিনি স্বৈরাচারী ছিলেন না। তদানীন্তন অবস্থায় রাজ্য পরিচালনায় তিনি কেন্দ্রীভূত শক্তির প্রয়ােজনের উপর সবিশেষ জোর দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন; কিন্তু খালসা’র গণতান্ত্রিক ধারাকে শ্রদ্ধা জানাইয়া প্রচলিত রীতিনীতিকে ভিত্তি করিয়াই তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি শিখজাতিকে জাতীয়তাবোধের উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল সত্য, কিন্তু শাসনকার্যে তিনি ছিলেন উদার, সুদক্ষ ও সুদৃঢ় শাসনব্যবস্থা পরমধর্মসহিষ্ণু। ধর্মনির্বিশেষে উপযুক্ত প্রতিভাবান ব্যক্তিগণকে তিনি রাজকার্যে নিযুক্ত করিতেন। তাহার প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন একজন মুসলমান ফকির আজিজউদ্দিন, রাজস্ব-মন্ত্রী ছিলেন একজন হিন্দু রাজা দীননাথ। তাহার শাসনব্যবস্থা ছিল সুদক্ষ ও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
রঞ্জিৎ সিংহ
তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী রাজা। বিনা প্রয়ােজনে তিনি কখনও রক্তপাত করিতেন না।* দূরদর্শী রাজনীতিজ্ঞের মত তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে তাহার শিখরাজ্য ইংরাজদের গ্রাস হইতে রক্ষা পাইবে না। তাই ভারতের একখানি মানচিত্র দেখিয়া তিনি বলিয়াছিলেন যে, “সব লাল হোে যায়গা!”