দেনাপাওনা উপন্যাস শরৎচন্দ্র বাংলা Teacj Sanjib
দেনাপাওনা উপন্যাস শরৎচন্দ্র বাংলা Teacj Sanjib
দেনাপাওনা
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
দেনা পাওনা উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সারাংশ
সারসংক্ষেপ :
যে কোনো সার্থক উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপণ। উপন্যাসের মুল লক্ষ্যে লেখককে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হয়। তাই উপন্যাসের মূল কাহিনীটি প্রথম পরিচ্ছেদেই উহার গতি-প্রকৃতি কেমন হবে তার পবাভাস পাঠকের মনে-একটা ধারণা দানা বাধতে থাকে। লেখক মল ঘটনায় বিন্যাসে ঘটনা পরম্পরায় জাল বিস্তৃত করেন প্রথম পরিচ্ছেদেই। ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র প্রথম পরিচ্ছেদটিতে এইরকম দায়িত্বই পালন করেছেন এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই।
বাকুড়া জেলার পাহাড় ঘেযা বাবই নদীর তীরে চন্ডীগড় গ্রাম। বহ, গ্রামীণ দেবতা চণ্ডীর নামেই গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। পবে উহার অনেক সম্পত্তি ছিল। পরবর্তী কালে মন্দির সংলগ্ন সামান্য কয়েক বিঘা ভমি ছাড়া সবটাই বীজগ্রামের জমিদারীর অন্তভূক্ত হয়। তারই জমিদার কালীবাব; ছিলেন অপুত্রক। তাই তার মতর পর তাঁর ভানে জীবানন্দ চৌধুরী জমিদার হলেন, ইনিই হলেন উপন্যাসের নায়ক। জীবানন্দ মদ্যপ, দুশ্চরিত্র-প্রজাদের কাছে মতিমান অত্যাচারের প্রতীক। উচ্ছথলতার জন্য কালীবাব ভানে জীবানন্দ চ ত্যাগ করার সংকল্প করেন। কিন্ত তাঁর আকস্মিক মততে তার সে-ইচ্ছা অপর্ণ থেকে যায়।
দীর্ঘদিন দেখাশনার অভাবে চণ্ডীগড়ের শান্তিকরে বাগান বাড়ীর অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। এ অবস্থায় জীবানন্দ হঠাৎ একদিন মাত্র দু’জন লােককে সাথে নিয়ে উপস্থিত হলেন শান্তিকুঞ্জে। দিন আষ্টেক থাকবেন। গোমতা এক কড়ির উপর ধার্য হয় অত্যাচারী জমিদার জীবনন্দের ভােগ বিলাসের জন্য বিভিন্ন কাজকর্ম।
তারাদাসের কন্যা অলকা বর্তমানে চণ্ডীগড় মন্দিরের ভৈরবীর ভূমিকায় ষােড়শী নামে পরিচিত—ইনিই উপন্যাসের নায়িকা। তার বয়স তেইশ-চব্বিশ—চেহারায় মেয়েলী শ্রীছাদ বলতে কিছু নেই। গ্রামের যত বােম্বেটে বদমাশের কাছে তিনি যেন সাক্ষাৎ- চণ্ডী। কথিত আছে অতি অল্প বয়সে অলকার বিয়ে হয় মাত্র একশ টাকার লােভে পলাতক আসামী জ্বীবানন্দের সাথে। বিয়ের রাত্রেই অলকাকে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে ওর পিতা তারাদাস বছর দশেকের মেয়ে অলকাকে নিয়ে আসে চন্ডীগড় গ্রামে। সেখানে ঘােড়শী নাম নিয়ে একটি পাত্র জুটিয়ে তারাদাস মেয়ের বিয়ে দিয়ে পাত্রকে অজ্ঞাত স্থানে চালান দেয়। তারপর থেকে দিব্যি বহাল-তবিয়তে মন্দিরের ভৈরবী হিসাবে ষােড়শী রয়েছে। আর তারাদাস কথায় কথায় জমিদারের সঙ্গে মামলা-মকদ্দমা বাঁধিয়ে চলে, তাই জমিদার মহলে তার সুখ্যাতি নেই। আবার ষোড়শীকেও এককড়ি রীতিমত ভয় করে।
দেনাপাওনা উপন্যাস: দেনা পাওনা উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অতএব গােমস্তা এককড়ি অসৎ চরিত্র জমিদার জীবনন্দের মন জয়ে ষােড়শী ও তার পিতা তারাদাসকে কাজে লাগায়। এককড়ির ধারণা প্রভুকে আনন্দে মাতিয়ে রাখলে তার উন্নতি হবে। এভাবেই প্রথম পরিচ্ছেদ শেষ হয়।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিচ্ছেদের মুল বিষয়বস্তু হলাে উপন্যাসের নায়ক জীবানন্দের সাথে সাক্ষাৎ হয় নায়িকা ষোড়শীর জমিদারের শান্তিকঞ্জে—যেখানে জমিদারের মনােরঞ্জনের জন্য মদ্য, মাংস, নারীর সব রকম ব্যবস্থা ছিল। এরকম পরিবেশে যােড়শীকে আনা হয়। সজিত ঘরের মধ্যে যেন সবাগে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরীর উচ্ছঙ্খল চরিত্রই বহন করে। বিশ বছর ধরে অবাধে নারীর দেহ নিয়ে যার বীভৎস লীলা চলেছে, সেই জমিদার আজ ষােড়শীর রপ দেখে বিস্মিত হলেন। উভয়ের কথাবার্তায় জীবানন্দের নিকট প্রকাশ পেল ষােড়শী কোনোদিন কোনাে অন্যায় কাজ করে নি। অবশেষে ষােড়শীর নিকট টাকা চাওয়া হলো, অনাদায়ে সেই রাত্রে তাকে ঐ বাড়ীতে বন্দী কতে হবে। এক রাত্রির জন্য জমিদারের কাছারিতে আটক থাকার অর্থ তার সর্বনাশ হওয়া। সমাজে সে মুখ দেখাতে পারবে না। অবশেষে ষোড়শীর তাই হলাে। কিন্তু, জীবানন্দের সেই পুরােনাে লিভাবের ব্যাথা প্রচণ্ড ভাবে বেড়ে ৪ায় অবশেষে ষোড়শীকেই সেবার কাজে এগিয়ে আসতে হয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদে এই দুটি নরনারীকে মুখােমখি এনে দাঁড় করিয়েছে পরস্পরকে এক স্নেহের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হতে। অবশেষে জীবানন্দের নিকট বিরাট প্ৰশ্ন মনকে আলোড়িত করে তােলাে—পথিবীর সব কিছুর প্রতি যার একান্ত অবহেলা, স্বামী-পুত্রবতী নারীর সতীত্ব নাশ করা যার নিত্য কর্ম–মা চণ্ডী কি তার মুক্তির ভার নিতে পারবেন। এভাবেই এক রাত্রির সেবা-যত্নে মদ্যপ জীবানন্দ পরিবতিত হলো অন্য এক মানব-সত্তায়-এ যেন রাত্রির অন্ধকার থেকে প্রাতকালীন সূর্যালোকে গমন। এমন কি তারাদাস গত রাত্রির ক্রিয়াকলাপকে নিজের মতো সাজিয়ে যে ফাঁদে জীবানন্দকে পুলিশ দিয়ে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করেছিল তা-ও ব্যর্থ হলাে। কথাপ্রসঙ্গে অতীতের কথা উঠে, উভয়ের পরিচয় স্পট হয়। অলকা তখন নিতান্ত ছেলে মানুষ।
সেদিনের সব কথা তার জানার কথা নয়। তার মা বেচে থাকলে বলতে পারত—সে। সত্যি কি চেয়েছিল। অসুস্থ জীবানন্দ এখন ষােড়শীর পশে জীবনের আশ্বাস পেয়েছেন। কিন্তু, ষােড়শী জীবানন্দের গৃহ থেকে যখন বেরিয়েছে তখন ভৈরবী হিসাবে তাকে ভীষণ চিন্তায় লজ্জিত করে তুলেছে, কারণ গ্রামবাসীরা তার সম্পর্কে বা ভাববে তা সহ্য করা কঠিন। এই ভাবনায় সন্ধ্যা অবধি তাকে একটি প্রাচীন তেঁতুল গাছের তলায় অপেক্ষা করতে হয়েছে। গ্রামের কথা, তারাদাসের কথা, জীবানন্দের মুখে অলকা নাম, তার ক্ষমা চাওয়ার কথা ইত্যাদি তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। অবশেষে সন্ন্যাসিনীকে উপবাসে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর নিজের গহে প্রবেশ করে বারান্দায় এক ধারে অচল বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।
পরদিন ভােরে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সে জানতে পারে মহাজন জনার্দন রায়ের নাতির মানত পূজা দিতে এসেছে তারই কন্যা হৈমবতী। এবং জামাতা নির্মল। আরেক দিকে গ্রামে যে তাকে নিয়ে একটা বিরাট কিছু ঘটতে চলেছে তা ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ অতিক্রম করে সপ্তম পরিচ্ছেদের সমাপ্তিতে তারই বর্ণনা রয়েছে। অবশ্য হৈমবতীই ষোড়শীর বিরুদ্ধে বদ্ধদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়। এই ফ্রান্তে দেখা গেল যে জমিদার কাছারিতে জীবানন্দ ও ভৈরবীর এক রাত্রির বসবাসকে কেন্দ্র করে একটি জোট বেধেছে, তাতে রয়েছে সর্বেশ্বর শিরােমণি, জনাদন, তারাদাস, প্রভৃতি।
সারাংশ অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদটি তারই সরগরমে পরিপুর্ণ। সমাজপতিরা ষোড়শীর ভৈরবী অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায়; কিন্ত; ভৈরবীর অধিকার সে ছাড়তে রাজী নয়। হৈমর প্রবল বাধাদানের ফলে ব্যাপারটি বেশী দুর গড়াতে পারে নি। এর জের চলে জনার্দন রায়ের বাড়ীতে। ভৈরবীর অধিকার খর্ব করার জন্য তারাদাস মন্দিরের যে ঘরগুলিতে তালা দিয়েছিল তা ষােড়শী তার লােক দিয়ে পুনরায় দখল করে নেয়। জলন্ত অগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ে। জনার্দন রায়ের ডাকে ষােড়শী ফকির সাহেবকে নিয়ে উপস্থিত হয়। জনার্দন সহ জামাই নিম’লও তাদের নানাভাবে অপদস্ত করতে গেলে ফকির সাহেবের তীক্ষবুদ্ধির কাছে সকলেই পরাজিত হয়। হৈম অশ্রুসজল নেত্রে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব উপলদ্ধি করে। স্বামীর হয়ে সে ফকির সাহেবের নিকট ক্ষমা চায় এবং স্বামীসহ তার আশ্রমে দেখা করতে চায়। আনন্দে তিনি অনুমতি দেন।
দেনাপাওনা উপন্যাস
নবম পরিচ্ছেদে ফকির সাহেব, যােড়শী ও জনার্দন রায়ের জামাতা ব্যারিস্টার সাহেবকে কেন্দ্র করে আবতিত হয়েছে। ফকিরের জিজ্ঞাস্য : ষােড়শী সহস্তে আর চণ্ডীর পূজা করবে না বলে জানিয়েছে কেন? ষোড়শী সেদিন জমিদারকে বাঁচালাে কেন? নিরুত্তর থাকাই শ্রেয় মনে করেছে ষােড়শী। ফকির সাহেবের যে শ্ৰধা, যে স্নেহ ছিল তার প্রতি, এতে তা কিছুটা খব হয়েছে। সারাদিন এ সব নিয়ে চিন্তিত ষােড়শী শেষ অবধি স্থির থাকতে না পেরে অপরাহ্নে চলে আসে ফকির সাহেবের আশ্রমে। কিন্তু, সে-দিন ফকির সাহেবের সাথে দেখা হয় নি–দেখা হয়েছে নির্মল বাবর সাথে। কথাবার্তায় বস সাহেবের মনে জেগেছে ষোড়শীর প্রতি শ্রদ্ধা।
দশম পরিচ্ছেদটির প্রকৃতিতে রপ পেয়েছে ভিন্নতর। ঘটনার ঘনঘটা নয় এখানে প্রাধান্য পেয়েছে হৃদয়ের সুক্ষ লীলা। জামাতার ফিরতে দেরী হওয়ায় জনদিন রায়ের বাড়ীতে হৈ চৈ পড়ে গেছে। তাদের সন্দেহ ষোড়শী তার অনুগত বাগদী প্রজা দিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারে। এমন সময় বসু সাহেব এসে হাজির। পৌছে দিল এই দুর্যোগের রাত্রে। জনার্দন তাকে পুরস্কৃত করতে চান। রাত্রে শোবার ঘরে একাকী হৈমকে সব কথা জানিয়েছেন নির্মল। মন্দিরে ষােড়শী যেমন রহস্যময়ী ছিল, আজও তেমনি রহস্যময়ী রয়ে গেছে। সাধারণ নিয়মে তার বিচার চলে না—এতে হৈম স্বামীকে ভুল বুঝে বেদনাত হয়েছে।
পরবর্তী পরিচ্ছেদে হৈম তার নিজের ভুল বুঝেছে। গত রাত্রির ব্যবহারে জন্য সে অনুতপ্ত। পুনরায় ভৈরবী আশ্রয়চ্যূত হয়েছে শুনে হৈম মর্মহিত। পশ্চিমে ফিরে যাবার কথা ছিল, তা স্থগিত রেখে রাত্রির অন্ধকারে হৈম ও নিমল এসেছে ষোড়শীকে সাহায্য করতে। হৈম সেই ফকিরের প্রশ্নগুলি উত্থাপন করলে ষােড়শী তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন সে দিনের জমিদারের কাছারিতে যা ঘটেছিল। মেয়ে মানুষ হওয়ায় ষােড়শীর পক্ষে গুরতর অপরাধ বলে যারা ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করেন তা থেকে হৈম ও নির্মলের ধারণা পরিবর্তন ঘটে। হৈম ও ষােড়শী উভয়ে আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিল : বিপদের দিনে তাদের স্মরণ করতে যেন সে না ভােলে।
দেনাপাওনা উপন্যাস
শরৎচন্দ্রের দেনা পাওনা উপন্যাস দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদে দেখানাে হয়েছে যােড়শীর মানসিক চিন্তা-ভাবনা। বিশেষ করে হৈম যেখানে স্বামী পত্র নিয়ে সুখের সংসার করেছে, ষােড়শীও সংসার করলে নিখুত গহিণীপনায় সেও নিজে কিছু মাত্র কম যেত না। তবু সে তার ভৈরবী জীবনকে গত বিশ বছর ধরে অনায়াসে গ্রহণ করে আসছে—একবারও নিজের জীবনকে নারীর জীবন বলে মনে হয় নি তার। পরমহতে তার জ্ঞান ফিরে এলাে এইভাবে যে সে চণ্ডী গড় ভৈরবী—সম্মানিতা, গরীয়সী এক অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয়; যে ষোড়শী লজিত হয়েছে ঐসব ভেবে। বীজগাঁর নিচ জাতি যারা জমিদারের অত্যাচারে উৎখাত হয়েছিল তাদের ষােড়শী স্থান দিয়েছিল বস্তু ও কৃষি জমিতে। সেই থেকে তারা ষােড়শীর প্রতি কৃতজ্ঞ ও একান্ত সহায়। তারা এসে জানিয়ে গেল যে মায়ের হুকম পেলে তারা রাতারাতি জমিদারকে মায়ের স্থানে বলি দিতে দ্বিধা করবে না। কারণ ষােড়শীকে তারা মা বলে সম্মান দেয়। পরদিন প্রাতে এক বুড়ি এসে জানায় জমিদার ষােড়শীকে ডেকেছেন। সঙ্গে এসেছিল অনেকেই যারা তামাসা দেখতে এসেছিল। ক্রদ্ধ ষােড়শী স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দেয় যে সে যাবে না।
দেনাপাওনা উপন্যাস
এরই প্রতিক্রিযায় সমাজপতিরা জমিদার ও ভৈরবীকে নিয়ে মহড়া চালাতে থাকে হয়ে দশ থেকে ষোড়শ পরিচ্ছেদ অবধি। এখানে সমাজপরিত একত্রিত হলেও নানাভাবে বিরক্ত। গ্রামের মাতবরেরা জমিদারের নিকট নালিশ জানাতে জড়ো হয়েছে— সেখানে রয়েছে জনার্দন, শিরােমণি, ঘােষজা, বােসজা, তারাদাস প্রভৃতিরা। প্রফুল্লমনে জমিদার জীবানন্দ দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে বসে মনযােগ সহকারে কথা শুনছিলেন। তাদের বক্তব্য ষােড়শীকে মা চণ্ডীর ভৈরবী পদ থেকে অব্যাহতি করার আদেশ দিতে। এতে জমিদার চমকে উঠলে কয়েকজন সমস্বরে জানালেন অপরাধ বেশ গুরুতর। কিন্তু, কি গুরতর তার ব্যাখ্যা দিতে কেহই সাহস পাচ্ছে না। এরই মধ্যে সকলের সামনে এক নিঃশ্বাসে এক গ্লাস হুইস্কি পান করে যে সব মন্তব্য করলেন তাতে উপস্থিত ব্যক্তিরা নিরাশ হয়ে গেল।
একদিকে সমাজপতিরা ভৈরবীকে তাড়াবার জন্য সক্রিয় আবার অন্যদিকে হজরের কাণ্ড দেখে সকলেই নিরাশ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করে সমাবেশ থেকে সকলেই বিদায় নিল। তার ওপর রয়েছে দীন-দুঃখীরা ভৈরবীকে যেভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে তাতে তাকে অপদস্ত করা খুবই কঠিন। তবু গ্রামের মোড়লরা ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেল ভৈরবীকে তাড়াতে । কিন্ত ষােড়শীর অনেক অনুগত প্রজারা মায়ের অপমানের প্রতিশােধ নিতে যে মত বরণ করতে পারে একথ্য গ্রামের মােড়লদের অজ্ঞাত ছিল না। এভাবে একটানা একটা ঊর্ধ্বশ্বাসের ভয়নিহত আতঙ্কে ভরপুর হয়ে ওঠে ষােড়ষীকে কেন্দ্র করে।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদে পব পরিচ্ছেদগুলির স্মৃতিচারণা চলে ষোড়শীর মধ্যে। এরই প্রতিফলনে দেখা যায় ষোড়শীকে যার স্মৃতিপটে এখনও বেদনা দেয় গ্রামের সমাজপতিত্বে বক্তব্যের প্রতিধনিতে, তিনিই একটি চিঠি লিখেছিলেন ষােড়শীর পাশে এসে দাঁড়াবেন বিপদের দিনে। বিশেষ করে চিঠির কাগজের টুকরােটি ভাবিয়ে তােলে নতুন ভাবনায়। হৈমর চিঠির ভাষাতে সে দিন যে চিঠিখানা সে লিখেছিল সেটা তারই অংশ। মনে পড়ে ফকির সাহেবের কথা, তিনি বলেছিলেন যে যথার্থ ডাকলে তখনই সে এসে হাজির হবে। ঠিক এমন সময় একজন এসে হাজির হন। ষােড়শী ভাবলাে এ নিশ্চিত ফকির সাহেব এসেছেন। কিন্ত দেখা দেখা জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী। ষােড়শী ভিত হয়ে যায়। যােড়শী আতঙ্কিত হয়ে স্থির হয়ে বসে থাকে।
সারাংশ দেনাপাওনা উপন্যাস
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে জীবানন্দের আত্মসমর্পণের কথােপকথন আর রয়েছে তার নিজস্ব আত্মকাহিনী। কথাবার্তায় চলে বিশেষ বিশেষ অনুরােধ যার মধ্যে একটা পরপর সহানুভূতিময় পরিবেশ মাতিয়ে তোলে। এভাবে তারা পরপর একে অপরের প্রতি আরাে নিকটতর হতে থাকে।
দেনাপাওনা উপন্যাস
কিন্তু, উনবিংশ পরিচ্ছেদে জীবানন্দ ও ষােড়শীর মধ্যে পুনরায় পরস্পর বিবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তারই বর্ণনা রয়েছে। তার সুত্রপাত আরম্ভ হয় সেই চিঠির ছেড়া অংশটিকে কেন্দ্র করে। উক্ত চিঠির প্রতি জীবানন্দ যে-সব মন্তব্য করল তাতে স্পষ্টই যােড়শী উপলব্ধি করল যে তাকে নিয়ে কলঙ্কিত চরিত্র প্রচার করা এবং অন্যদিকে হৈমর সুখের সংসারে চিরবিচ্ছেদ ঘটান। এর ফলে ষােড়শীর কলঙ্ককে কেন্দ্র করে শ্বশুর-জামাতা, পিতা-কন্যা ও জমিদার-প্রজার মধ্যে সমস্ত গ্রাম জুড়ে যে তাণ্ডবের ঝড় উঠবে তার বীভৎসতার কালােছায়া যে রপরেখা ফুটে উঠবে যোড়শী তা কল্পনা করতে পারল না তার নিজের ভবিষ্যত ভাবনায়।
বিংশ পরিচ্ছেদটি সম্পূর্ণ আলােচিত হয়েছে নির্মলের চণ্ডীগড়ে পুনরায় হঠাৎ আসা নিয়ে। প্রথমেই তিনি ধাক্কা খেলেন শ্বশুর-শাশুড়ীর কথাবার্তায়। তারা পষ্টই বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি এসেছেন ষােড়শীকে বাঁচাতে। যে উৎসাহ নিয়ে তিনি এসেছিলেন তা যেন ক্রমে অবনতির পথে চলে যাচ্ছে জীবানন্দের কটুক্তি মন্তব্যের ফলে। নির্মলের আশা ছিল যে সমবেত ও প্রবল শক্তি সমূহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বল, পরিত্যক্ত, নির্যাতীতা নারীর নিঃস্বার্থ বন্ধুরূপে এ-গ্রামে সে পদার্পণ করবে। কিন্তু, এসে দেখল সকল কার্যেই একটি প্ররােচনা মূলক ব্যাখ্যা তৈরী হয়ে রয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। তবু তিনি এসে হাজির হলেন ষোড়শীর কুটির প্রান্তে। কথাবার্তায় একটা গতি লাভ করলে অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় নির্মল চলে যাবার প্রস্তুত হ’লে ষােড়শী তাকে সন্ধ্যার পর মন্দিরে আসতে অনুরােধ জানায় কারণ মন্দিরে একটা হাঙ্গামা হতে পারে।
দেনাপাওনা উপন্যাস
একবিংশ পরিচ্ছেদে নির্মলকে নিয়ে শ্বশুর জনার্দন এবং শাশুড়ীর মধ্যে চণ্ডীগড়ের ভৈরবীকে নিয়ে যে আলাপ আলােচনা হয় তাতে কোনো সমাধান সত্র পাওয়া গেল না ; বরং যার যেখানে অবস্থান ছিল সে সেখানেই রয়ে গেল। সন্ধ্যার পর আরতি পর্বের পর মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েতে একটা যে কোলাহল উঠেছে তা অন্ধকারে নির্মল প্রত্যক্ষ করছেন। এমন সময় ষোড়শী এসে তাকে নিয়ে নিজ কুটীরে প্রবেশ করে দেখে, ফকির সাহেব নেই। খানিক কথাবার্তায় নির্মল বুঝিয়ে দিলেন মামলায় হারবার কোনাে সভাবনা আমাদের নেই। এমন সময় একজনের আগমন বার্তায় ফকির সাহেব আসছেন বলে যােড়শীর ধারণা হলো, কিন্ত, যিনি এলেন তিনি স্বয়ং জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী।
ঘরে প্রবেশ বাবিংশ পরিচ্ছেদ জমে উঠেছে ষোড়শী, নির্মলবাবু এবং জীবানন্দবাবর আলােচনার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে এই অঘটন কাজের শান্তিপণ সমাপ্তকরণ কি ভাবে হতে পারে। প্রাথমিক স্তরে রসিকতাপণ আলোচনা থেকে এক গাম্ভীর্যময় পরিবেশে উত্তরণের মাধ্যমে ষােড়শী ভৈরবীর পদ পরিত্যাগ করে জীবানন্দ বাবর হাতে মন্দিরের চাবি অপণ করে। বিস্মিত হলেন উভয়েই। তারপর হাসি-তামাসাময় কথা-বাতরি মাধ্যমে নিমল নমকার জানিয়ে চলে যান। তারপর জীবানন্দ ও ষােড়শীর মধ্যে চলে অতীত স্মৃতিচারণা। করেই তিনি জানতে চাইলেন ইনি নির্মলবাবু কিনা ?
এয়ােৰিংশ পরিচ্ছেদে দেখা গেল জীবনন্দের সম্পূর্ণ ভাবান্তর পর্ব—এ পর্বের সুত্রপাত হয় ষোড়শীর চন্ডীমাতার চাবি হস্তান্তরের কাল থেকে। গ্রামের সমাজপতিরা সন্তুষ্ট নন, কারণ তারা চান না জমিদারের হাতে চাবির দায়িত্ব রাখতে। তারা একত্রিত হয়ে যথা সময়ে জমিদারের শান্তিকুঞ্জে এসে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেল যে জীবানন্দ মদের পরিবর্তে মোটা মােটা খাতাপত্র নিয়ে হিসাব পরীক্ষা করছে, সঙ্গে রয়েছে তার সেক্রেটারী প্রফুল্ল। সন্ধ্যায় তিনি মদের পরিবর্তে চা সেবন করছেন—এ এক সপর্ণ বিপরীত মেরর জীবানন্দ।
চতুবিংশ পরিচ্ছেদে রয়েছে পাপিষ্ঠ জীবানন্দের অনুশােচনা এবং তার চরিত্রগত পরিবর্তনের পটভূমিকা এবং ষােড়শীর বিদায় পর্ব। ষােড়শী সম্পর্কে জীবানন্দের পরিবর্তিত মনােভাব এখানে পষ্ট। জীবানন্দের পরিবর্তন যে ভাবে অগ্রসর হচ্ছে তার মূলে রয়েছে ষোড়শীর প্রভাব। তিনি যোড়শীর বিদায় কালে নিষ্পাপ রমণীর চরিত্র চিন্তা করে নিজের অতীত দুষ্কর্মের জন্য অনুশােচনা করছেন। এখানে আমরা যেন অন্য এক জীবানন্দকে দেখে বিস্মিত হই।
দেনাপাওনা উপন্যাস
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে ষোড়শী ভৈরবী পদে ইস্তফা দিয়ে সেচ্ছার চণ্ডীগড় ছেড়ে যাবার শেষ মুহূর্তে জীবানন্দের সাথে ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে এক কর্মপন্থা নির্ধারণের ইঙ্গিত। সে-ইঙ্গিত জীবানন্দ যে চিঠিটা তাকে সে সময় দিয়েছিল সেখানে সবই বিস্তৃত ভাবে লেখা রয়েছে। উক্ত লেখার সারমর্মে ষোড়শীও অভিভুত। বিদায়ের সবশেষে জীবানন্দের অনুশোচনাগুলি একটা অব্যক্ত সীমাহীন ব্যাকুল ধনি ষােড়শীর কর্ণগােচরে ক্রমান্বয়ে আঘাত হানতে থাকে। আর প্রগাঢ় অন্ধকারে ঠিক সেইখানেই জীবানন্দ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ষষ্ঠবিংশ পরিচ্ছেদে
ষষ্ঠবিংশ পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে সমাজ শাসিত সেই সমাজপতিরা দ্বিধাবিভক্ত এবং জীবনন্দের সম্পূর্ণ পরিবর্তন নিয়েই বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে বীজগ্রামের জমিদারদের প্রমােদভবন আর তার মাতামহের খুব প্রিয় শান্তিকুঞ্জ, ভস্মীভূত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আরো বিষাক্ত পরিবেশ সষ্টি হয়। এর ফলে জনার্দন, শিরোমণি, প্রভৃতিরা জমিদারের পরিবর্তিত অবস্থানে কঠোরতা উপলব্ধি লক্ষ্য করে প্রত্যেকেই রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যার কেন্দ্র বিন্দুতে সরে পড়ে।
দেনাপাওনা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
– অার সপ্তবিংশতি পরিচ্ছেদে দেখা যায় জামাতা নির্মলের আবির্ভাব এবং শ্বশুর জনার্দন রায়কে বাঁচাবার নিরলস প্রয়াস। অবশেষে অপরাহ্নে মাঠের মধ্যে জীবানন্দের সাক্ষাৎ ঘটে নির্মলের। সেখানে নির্মল লক্ষ্য করল যে জীবানন্দের আচরণে গরিমা নেই, কৃত্রিমতা নেই, মাদকতা নেই—আছে শুধ, সরলতা, সহজ মনের অভিব্যক্তি। প্রতিটি কাজের মধ্যে ফুটে উঠেছে নতন দৃষ্টিভঙ্গী যা সর্বসাধারণের গ্রহণযােগ্য। নির্মল বিস্মিত হয়ে জীবানন্দের পরিবর্তন উপলব্ধি করে। তাদের কথাবার্তা একটা উত্তম পরিবেশে অগ্রসর হতে থাকে। সুযােগ বুঝে নির্মল তার মিমাংসার প্রস্তাব উথাপন করলে পষ্ট ভাষায় জীবানন্দ জানিয়ে দেয় যে কৃষকরা আর জুলম সহ্য করবে না। আজ এ অত্যাচার বন্ধ করতেই হবে। অবশেষে নির্মল নিরাশ হয়ে চলে আসে। জনার্দন মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে যে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করে তা সবই বৃথা গেল। অবশেষে সদরে নির্মল ও ফকির সাহেবের সাক্ষাতের মাধ্যমে একটা মিমাংসের সত্ৰ মিলবে বলে নির্মলের একটা ধারণা সষ্টি হয়।
অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ বা সমাপ্তি পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে জীবানন্দের মানসিক পরিবর্তনের চুড়ান্ত পরিণতি। যে অনাচার, অত্যাচার উৎপীড়ন এতদিন চলছিল, তা যে পরষানুক্রমে তাদের যে পরিশােধ করতে হবে এটাই জীবানন্দের শেষ কথা। ষোড়শীও তার আত্মসমর্পণের দ্বারা জীবানন্দের সর্বস্ব জয় করে সহ-অবস্থানে রয়েছে তারই চিত্ররপ। এখানে এই মানসিকতার বিবর্তনটি অতি সহজে ও বিশ্বাসযােগ্য করে একেছেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র।
দেনাপাওনা উপন্যাস