ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা আলােচনা কর।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা আলােচনা কর।
অথবা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা পর্যালােচনা কর
অথবা, ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা পর্যালােচনা কর।
মহাত্মা গান্ধীর মুক্তি সংগ্রাম:
উত্তর।
১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাহার নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা হইল। তিনি জাতীয় সংগ্রামকে একটি সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলনে পরিণত করেন। জওহরলাল নেহরু ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর আগমনকে “আলাের ঝলকের
সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন, কারণ তাহার নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন প্রাণচঞ্চল ও কর্মমুখর হইয়া উঠিল।
গান্ধীজীর রাজনৈতিক পথ ও পদ্ধতি : গান্ধীজী জাতীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে নতুন পথ ও পন্থা .উপস্থাপিত করেন। নরমপন্থী সহযােগিতার নীতি বর্জন করিয়া তিনি চরম পন্থী অসহযােগিতার নীতি গ্রহণ করেন। আবার অন্যদিকে তিনি প্রথম দিকে নরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থক ছিলেন। বিপ্লববাদীদের অভয় মন্ত্র ও তাহাদের শৌর্যবীর্যের প্রতি তাহার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু অন্যদিকে তিনি হিংসা ও অসত্যের ঘােরতর বিরােধী ছিলেন। সাম্যবাদীদের সামগ্রিক গণ-সংগ্রামের নীতির প্রতি গান্ধীজীর কোন বিরােধ ছিল না, কিন্তু সহিংস ও শ্রেণী সংগ্রামের নীতিতে তিনি আস্থাশীল ছিলেন না। সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি সকল স্তরের মানুষের সমাবেশ চাহিয়াছিলেন এবং জাতি, ধর্ম, গােষ্ঠী সবার উর্ধে উঠে অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন মূর্ত প্রতীক
গান্ধীজীর সংগ্রামের রণকৌশল সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত। সত্যের ভিত্তিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামই হইল সত্যাগ্রহ। গান্ধীজীর মতে সত্যাগ্রহ একটি মহান ধর্ম। সত্যাগ্রহকে তিনি নৈতিক সংগ্রামের পরীক্ষা-নিরীক্ষা রূপে গ্রহণ করেন এবং তাহার মতে সত্যাগ্রহী সর্বদা নিজেকে পর্যালােচনা করিবেন এবং বিপক্ষকেও তাহা করিতে বাধ্য করিবেন।
১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ-আফ্রিকায় তাহার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। সেই সময় দক্ষিণ-আফ্রিকায় ভারতীয়দের উপর শ্বেতাঙ্গ শাসকদের অমানুষিক অত্যাচার চলিতেছিল। প্রবাসী ভারতীয়দের দুঃখ-দুর্দশা তাহাকে বিচলিত করে এবং তিনি সত্যাগ্রহ সংগ্রামে অবতীর্ণ হইলেন। গান্ধীজী এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে দক্ষিণ-আফ্রিকার বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করিলেন অধ্যাপক জুডিথ ব্রাউন দক্ষিণ-আফ্রিকায় গান্ধীজী পরিচালিত আন্দোলনকে তাহার পরবর্তী ভারতীয় আন্দোলনের প্রস্তুতি-পর্ব বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভারতবাসীর মধ্যে তিনি ঐক্যের সেতু রচনা করিতে সমর্থ হন।
ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীজীর উত্থান :
১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে গান্ধীজী ভারতে ফিরিয়া আসিলেন। শীঘ্রই তিনি তিনটি আঞ্চলিক সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট হইলেন। বিহারের চম্পারণে নীলচাষীদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, আমেদাবাদের কারখানা শ্রমিকদের ধর্মঘটের সপক্ষে ও গুজরাটে কৃষক আন্দোলনে গান্ধীজী অহিংস-সত্যাগ্রহ নীতি প্রয়ােগ করেন এবং সর্বত্রই তাহা জয়যুক্ত হইল।
ইহার পর গান্ধীজী সর্বভারতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করিলেন। রাওলাট আইন। গান্ধীজীর রাজনৈতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটাইল। এতদিন তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের একজন অনুগত নাগরিক। কিন্তু রাওলাট আইন তাঁহাকে বিদ্রোহী করিয়া তুলিল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে তিনি শয়তানের প্রতিভূ বলিয়া মনে করিলেন।
গান্ধীজী রাওলাট আইনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দিলেন। ১৯১৯ খ্রষ্টাব্দের ১৩ মার্চ এই ধর্মঘট পালিত হইল। গান্ধীজীর ব্যক্তিগত পরিচালনায় বােম্বাই-এ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে উদ্যাপিত হইল। রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়িয়া তুলিয়া গান্ধীজী সর্বভারতীয় নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। ইতিমধ্যে রাওলাট আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবে যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সংঘটিত হইল তাহা ব্রিটিশ সরকার নির্মমভাবে দমন করিতে উদ্যত হইলেন। পাঞ্জাবের দুইজন জনপ্রিয় নেতা ডাঃ কিচলু সত্য পালের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে এক বিশাল বিক্ষোভ জমায়েত হয়। অমৃতসরের সামরিক অধিনায়ক জেনারেল ও-ডায়ার জনগণের উপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দিলেন। সরকারী মতে ৩৭৯ জন নিহত ও বারােশত লােক আহত হয়। কিন্তু রে-সরকারী হিসাবে নিহতের সংখ্যা সহস্রাধিক ছিল, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে সমগ্র ভারতে তীব্ৰক্ষোভের সঞ্চার করিল। কংগ্রেস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করিল এবং মহাত্মা গান্ধী এই কমিটির অন্যতম সদস্য হইলেন।
সুতরাং দেখা যায় ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে এক সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও জটিল হইয়া উঠে। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে সেভার্সের-সন্ধিতে তুরস্ক সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন সুনিশ্চিত হওয়ায় ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায় বিক্ষুব্ধ হইলেন। তুরস্কের সুলতান ছিলেন ইসলাম জগতের খলিফা বা ধর্মগুরু। তাই তাহার অবমাননা হওয়ায় ভারতীয় মুসলমানদের মনে ব্রিটিশ-বিরােধী মনােভাব সৃষ্টি হইল। খলিফার সম্মান রক্ষার জন্য নিখিল ভারত খিলাফত কমিটি গঠিত হইল। এই পরিস্থিতিতে মহাত্মা গান্ধীর সুযােগ্য নেতৃত্বে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সমর্থনের ভিত্তিতে এক গণ-আন্দোলনের পরিবেশ রচিত হইল এবং খিলাফত ও অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হইল।
মহাত্মা গান্ধী ও অসহযােগ আন্দোলন :
১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে নিখিল ভারত খিলাফত কমিটি সরকারের সঙ্গে সর্বপ্রকার অসহযােগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। গান্ধীজী খিলাফত প্রশ্নে পূর্ণ। সমর্থন জানাইলেন কারণ ইহার ফলে ভারতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত আন্দোলন সম্ভব হইবে। শীঘ্রই গান্ধীজী অহিংস-অসহযােগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কলিকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীজীর অহিংস-আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হইল। অসহযােগ আন্দোলনের তিনটি মূল লক্ষ্যের ব্যাপারে কংগ্রেস ও খিলাফত কমিটি একমত হয়। এই তিনটি দাবি হইল পাঞ্জাবের অভিযােগের সন্তুষ্টিকরণ, খিলাফতের প্রতি ব্রিটিশ তথা মিত্রপক্ষের অন্যায়ের অবসান এবং ভারতবাসীকে স্বরাজ দান।
অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য গান্ধীজী দুই ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করেন, গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক। গঠনমূলক কর্মসূচীর মধ্যে ছিল এক কোটি টাকার তহবিল গঠন, এক কোটি সদস্যের সেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, ২০ লক্ষ চরকা বিতরণ, জাতীয় স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও গ্রামােন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বদেশী দ্রব্যের উৎপাদন। ধ্বংসাত্মক কর্মসূচীর মধ্যে। উল্লেখযােগ্য হইল সরকারী আইন-আদালত ও শিক্ষায়তন বর্জন, সরকারী খেতাব ও পদক প্রত্যাহার, মাদক দ্রব্য বর্জন, বিদেশী বস্ত্র বর্জন ও আইন সভার নির্বাচন বর্জন।
গান্ধীজীর আহ্বানে সমগ্র ভারতে এক অভূতপূর্ব আলােড়ন সৃষ্টি হইল এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিলেন। অনেকে আইন ব্যবসা পরিত্যাগ করিলেন, দলে দলে ছাত্ররা সরকারী শিক্ষায়তন ত্যাগ করিল। অনেকস্থানে কৃষকশ্রেণী স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যােগদান করিল। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বরে প্রিন্স অব ওয়েল-এর আগমনকালে বােম্বাইয়ে হরতাল পালিত হইল। ইহার পর ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে আন্দোলন পরিচালনার সর্বময় কর্তৃত্ব গান্ধীজীর উপর ন্যস্ত করা হইল।
অসহযােগ আন্দোলনের ব্যাপক সাফল্যে ব্রিটিশ সরকার ভীত হইয়া রূদ্রমূর্তি ধারণ করিলেন। কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী বে-আইনী বলিয়া ঘােষিত হইল। শীর্ষস্থানীয় নেতারা কারারুদ্ধ হইলেন। এদিকে ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলায় উত্তেজিত জনতা চৌরী-চৌরা থানা আক্রমণ করে এবং ইহার ফলে ২২ জন পুলিশ নিহত হয়। আন্দোলনের অহিংস চরিত্র বিনষ্ট হওয়ায় গান্ধীজী অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়া ইলেন। দুঃখের বিষয় আন্দোলন বন্ধ করিবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজীকে প্তের করিলেন এবং ছয় বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন।
মহাত্মা গান্ধী ও আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-৩৪ খ্রীঃ) :
অসহযােগ আন্দোলন (১৯২০-২২ খ্রীঃ)-এর মধ্য দিয়া গান্ধীজীর নেতৃত্বে যে অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনের সূচনা হয় তাহা আইন-অমান্য লেনের ফলে আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।
ভরতে স্বায়ত্তশাসন দাবি কার্যকর করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের অনমনীয় মনােভাবে বিক্ষুব্ধ হইয়া গান্ধীজি লাহােরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে (ডিসেম্বর, ১৯২৯ খ্রীঃ) পূর্ণ সাধনত ও আইন অমান্য সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে গান্ধীজি নতুন সত্যাগ্রহ পরিকল্পনা ঘােষণা করিলেন। ঠিক হইল, কেবল মাত্র অসহযােগ নহে, সক্রিয় আইন অমান্য আন্দোলন সংঘটিত হইবে।
১৯৩০ ষ্টপ ১২ই মার্চ গান্ধীজী ৭৮ জন সহযােগী লইয়া সবরমতী আশ্রম হইতে সন, উপকূলবর্তী তাভিমুখে রওনা হইলেন এবং সেখানে গিয়া লবণ-আইন ভঙ্গ করলেন। এইরে অাইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হইল। এই
আইন তামান্য আন্দোলন সমগ্র ভারতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করিল। কৃষক, মহিলা সকলেই আন্দোলনে সামিল হইল। সমস্ত দেশে একলক্ষ সত্যাগ্রহী কারারুদ্ধ হইলেন। ৫ই মে গান্ধীজী গ্রেপ্তার হইলেন।
আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখিয়া বড়লাট লর্ড আরউইন গান্ধীজীর সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদিত করিলেন (মার্চ, ১৯৩১ খ্রীঃ)। এই চুক্তি অনুসারে সরকার সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিলেন এবং অন্যদিকে কংগ্রেস আইন-অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়া ইংল্যাণ্ডে অনুষ্ঠিত গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের সিদ্ধান্ত লইল। কিন্তু গান্ধীজী দ্বিতীয় গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করিলেও রিক্ত হস্তে দেশে ফিরিয়া আসিলেন। এদিকে সরকারী দমননীতিতে ক্ষুব্ধ হইয়া গান্ধীজী পুনরায় আইন-অমান্য আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে গান্ধীজী গ্রেপ্তার হইলেন, সরকার অর্ডিনান্স জারি করিয়া ভারতবাসীর রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুন্ন করিতে উদ্যত হইলেন। অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসকবর্গ কুখ্যাত ‘সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা’ ঘােষণা করায় ভারতীয় রাজনীতিতে জটিলতা বৃদ্ধি পাইল। গান্ধীজী হিন্দুসমাজের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য দীর্ঘ অনশন শুরু করিলেন। গান্ধীজীর অনশন নিরসনের জন্য বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত সম্প য়র নেতারা পুণা-চুক্তি সম্পাদন করিলেন (সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রীঃ)। এদিকে ব্রিটিশ সরকারের দমন নীতির ফলে আইন-অমান্য আন্দোলন স্তিমিত হইয়া পড়িল এবং গান্ধীজী ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে আইন-অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়া লইলেন। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইলেও আইন-অমান্য আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও গণমুখী ও গতিশীল করিয়া তুলিল।
মহাত্মা গান্ধী-ভারত-ছাড় আন্দোলন :
গান্ধীজীর নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামের চরম পরিণতি দেখা যায় ভারত-ছাড় আন্দোলনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের অগণতান্ত্রিক ও অনমনীয় মনােভাবের প্রতিবাদে গান্ধীজী এই সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানী আক্রমণের পটভূমিকায় গান্ধীজী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে ভারত ছাড়িয়া যাইবার নির্দেশ দিলেন এবং এই মর্মে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ভারত-ছাড় প্রস্তাব গ্রহণ করে। গান্ধীজী দেশবাসীকে “করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গ” মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করিয়া আন্দোলনে জনগণকে সামিল হইতে আহ্বান জানাইলেন।
কিন্তু এই প্রস্তাবিত আন্দোলন শুরু হইবার পূর্বেই গান্ধীজী ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় জাতীয় নেতারা কারারুদ্ধ হইলেন। কিন্তু নেতারা কারাগারের অন্তরালে থাকিলে জনগণ অহিংস ও সহিংস উভয় পথেই পুঞ্জীভূত বিক্ষোভকে স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহে পরিণত করিল। এই স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন দমন করিবার জন্য ব্রিটিশ সরকার সর্বশক্তি নিয়ােজিত করিলেন। লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হইলেন, বন্দীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চলিল। পুলিশ ও সৈন্যবাহিনীর গুলি বর্ষণে দশ হাজারের বেশী নিহত হইল। এইভাবে আগস্ট আন্দোলন ব্যর্থ হইল।
ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করিলেন যে ভারতে তাহাদের শাসনের অবসান আসন্ন। বস্তুতঃপক্ষে ভারত-ছাড় আন্দোলন ছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সংগ্রামের সর্বোচ্চ পরিণতি।
মহাত্মা গান্ধীর মুক্তিসংগ্রামের মূল্যায়ন :
ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে গান্ধীজীর প্রধানতম অবদান হইল যে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিধি প্রসারিত করিয়া সর্ব ভারতীয় গণ-আন্দোলনে পরিণত করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা, ধর্ম, জাতি ও বর্ণগত বৈষম্যের ব্যবধান ঘুচাইয়া ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঐক্য ও সংহতি স্থাপিত হইল। সমাজের নিপীড়িত নিষ্পেষিত জনগণ যথা হরিজন ও বিভিন্ন উপজাতি জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতধারার সঙ্গে সংযুক্ত হইয়া পড়িল। ইহা ভিন্ন খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করিয়া তিনি হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যবন্ধন গড়িয়া তুলিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন।
কিন্তু গান্ধীজী পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের তিনটি প্রধান দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, গান্ধীজী সর্বভারতীয় ভিত্তিতে গণ-আন্দোলন পরিচালনা করিতে সমর্থ হইলেও আন্দোলনকে তিনি কখনও সাফল্যের শীর্ষে লইয়া যান নাই। অসহযােগ আন্দোলন, আইন-অমান্য আন্দোলন—দুই সময়েই তিনি মধ্য পথে আন্দোলন স্থগিত রাখিবার নির্দেশ দেন। এইজন্য রজনীপাম দত্ত গান্ধীজীকে “Jonah of revolution” এবং general of unbroken disasters’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সংগ্রামের অপর বিচ্যুতি হইল আদর্শগত। গান্ধীজী ছিলেন জাতীয় উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের (National bourgeois) প্রতিনিধি। তাই তিনি উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের শ্রেণীস্বার্থ দ্বারা জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত করিতে সচেষ্ট হন। এইজন্য তিনি শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের স্রোতধারার সঙ্গে সংযুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। গান্ধীজী পরিচালিত জাতীয় সংগ্রামের অপর মারাত্মক ত্রুটি হইল সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে। যদিও তিনি আজীবন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতীক ছিলেন এবং অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ছিল তাহার অভীষ্ট লক্ষ্য, কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হয় নাই। জীবনের সায়াহ্নে তিনি আত্মঘাতী হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেখিলেন। এই শােচনীয় পরিস্থিতির পরিণতিরূপে ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগ হইল। আজীবন অহিংস ও সম্প্রীতির পূজারী গান্ধীজী সাম্প্রদায়িক গৃহযুদ্ধকে প্রতিহত করিতে ব্যর্থ হইলেন।
সুতরাং দেখা যায় রাজনৈতিক দিক দিয়া গান্ধীজী সম্পূর্ণ সফলতা অর্জন করিতে পারেন নাই। কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে গান্ধীজীর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁহার নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় আন্দোলন এক সর্বাত্মক গণ-সংগ্রামে পরিণত হইল এবং সমগ্র দেশ আত্মত্যাগ ও আত্মবিশ্বাসের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল। সর্বোপরি, গান্ধীজী শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন সত্য ও অহিংসার পূজারী এক মহান মানবতাবাদী। গান্ধীজী কংগ্রেস আন্দোলনের সঙ্গে নারীমুক্তি, হরিজন-উন্নয়ন, অস্পৃশ্যতা মােচন, আদিবাসী পরিসেবা প্রভৃতি সামাজিক বিষয়গুলিকে সংযুক্ত করিয়াছিলেন। একদিকে গঠনমূলক কাজ অন্যদিকে গণ-আন্দোলন এই দুইটি দিককে সংশ্লিষ্ট করিয়া গান্ধীজী শুধুমাত্র জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন নাই, জাতীয় জীবনে সংহতি সাধন করিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন।