প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো

 

●  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ কী ছিল আলােচনা করাে।

 

 উত্তর

 

১৮৭১ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ইউরােপে বড়াে ধরনের কোনাে যুদ্ধ না হলেও আপাত শান্তির আড়ালে বাতাসে বারুদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। শান্তির আড়ালে যুদ্ধের এই পরিস্থিতি সশস্ত্র শান্তির যুগ’ নামে পরিচিত। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপে শান্তি ভঙ্গ হয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। 

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ:-

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধের (১৯১৪ ১৮ খ্রি.) বিভিন্ন কারণ ছিল।

 

১)  জার্মানির আগ্রাসী নীতি: কাইজার-[i] বিসমার্কের স্থিতাবস্থার নীতি ত্যাগ করে বুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি বাতিল (১৮৯০ খ্রি.) করেন, [ii] রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার আগ্রাসনে উৎসাহ দেন, [] ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় বিদ্রোহী বােয়ারএর প্রেসিডেন্ট ঢুগারকে সমর্থন করেন এবং [iv] বার্লিন-বাগদাদ রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।

প্রথম-বিশ্বযুদ্ধের-কারণ-ও-ফলাফল-আলোচনা-করো

 

2) অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ : ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে ইউরােপের বিভিন্ন জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সােচ্চার হয়। আলসাস ও লােরেইন পাওয়ার জন্য ফরাসিরা, ট্রিয়েস্ট ও ট্রেনটিনাে পাওয়ার জন্য ইতালীয়রা, শ্লেসউইগ পাওয়ার জন্য ডেনরা, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডবাসী আন্দোলন শুরু করে।

 

৩) বলকান জাতীয়তাবাদ : এশিয়ার অটোমান তুর্কি শাসকদের। অধীনস্থ পুর্ব ইউরােপের বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি স্বাধীনতার দাবিতে ক্রমেই সােচ্চার হয়ে ওঠে। সার্ব জাতি অধুষিত বসনিয়া ও হার্জেগােভিনা নামে দুটি প্রদেশ সার্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেও বার্লিন চুক্তির (১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা তাদের জোর করে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তাই প্রদেশ দুটিতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।

 

৪) উগ্র জাতীয়তাবাদ : বিংশ শতকের শুরুতে ইউরােপের বিভিন্ন দেশে উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। এই সময় ইউরােপে বিভিন্ন উগ্র জাতীয়তাবাদী মতবাদের উন্মেষ ঘটে এবং ইউরােপের প্রতিটি জাতি নিজ জাতিকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্য জাতিগুলিকে নিকৃষ্ট বলে মনে করতে থাকে। রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি দেশেও উগ্র জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যান্য কারণ:

৫) ঔপনিবেশিক সংঘাত : ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে আগে শিল্পায়ন ঘটায় তারা এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ বিস্তারে এগিয়েছিল। জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি ইউরােপীয় দেশে পরে শিল্পায়ন ঘটায় তারা সেই শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার অন্বেষনের জন্য উপনিবেশ দখল করতে গেলে অন্যদের সঙ্গে তাদের সংঘাত বেধে যায়।

 

৬) জার্মানির নৌশক্তি বৃদ্ধি; নতুন উপনিবেশ দখলের জন্য জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম বিশাল জার্মান নৌবহর গঠনের কাজে হাত দেন। এতে আতঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ডও পালটা নৌশক্তি বৃদ্ধি শুরু করে।

 

৭) পরস্পর-বিরােধী শিবির : বিংশ শতকের শুরুতে ইউরােপ পরস্পর-বিরােধী দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে যায

 

[i] ত্রিশক্তি চুক্তি:ফ্রান্সকে নিঃসঙ্গ করে রাখার উদ্দেশ্যে জার্মানির প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের উদ্যোগে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইটালির মধ্যে ত্রিশক্তি চুক্তি (১৮৮২ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়।

 

 [i] ত্রিশক্তি আঁতাত: ত্রিশক্তি জোটের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মধ্যে ত্রিশক্তি আঁতাঁত বা ত্রিশক্তি মৈত্রী গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ক্রমশ অস্ত্র প্রতিযােগিতা শুরু হয়।

 

৮)  ফ্রান্সের ক্ষোভ : ফ্রান্স সেডানের যুদ্ধে (১৮৭০ খ্রি.) প্রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে কয়লা ও লােহার খনিসমৃদ্ধ আলসাস ও লােরেইন নামক স্থান দুটি জার্মানিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশােধ গ্রহণ এবং আলসাস ও লােরেইন পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ফ্রান্স জঙ্গি মনােভাব নিয়ে জার্মান-বিরােধী জোট তৈরি করে এবং ইউরােপে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে।

 

৯) মরক্কো সংকট ; ফ্রান্স আফ্রিকার মরক্কোয় উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করলে জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মরক্কোর সুলতানের পাশে দাঁড়ান এবং ‘প্যান্থার’ নামে একটি যুদ্ধজাহাজকে মরক্কোর আগাদির বন্দরে ঢুকিয়ে দেন। ফলে ফ্রান্স ও জার্মানির সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

 

১০) সেরাজেভাের হত্যাকাণ্ড : অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফার্দিনান্দ ও তার স্ত্রী সােফিয়া সার্ব জাতি অধ্যুষিত বসনিয়া সফরে এলে (১৯১৪ খ্রি.) তারা সেরাজেভাে শহরে এক বসনীয় ছাত্রের হাতে নিহত হন (২৮ জুন)। অস্ট্রিয়া এই হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র সার্বিয়াকে দায়ী করে বিভিন্ন কঠোর শর্তাদি সহ একটি চরমপত্র পাঠায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল্যায়ন:

উপসংহার; অস্ট্রিয়ার চরমপত্রের কিছু শর্ত মানলেও অবশিষ্ট শর্তগুলির বিষয়ে আলােচনার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক বৈঠক ডাকার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অস্ট্রিয়া এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করে। কিছুদিনের মধ্যে ইউরােপ ও ইউরােপের বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্র ভিন্ন ভিন্ন বিবদমান পক্ষে যােগ দিলে তা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।

◆ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন ফলাফলগুলি উল্লেখ করাে। 

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮ খ্রি.) ছিল বিশ্বের প্রথম ভয়ংকরতম যুদ্ধ।

 

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ও বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ নষ্ট হয় তা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি।

 

১) সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যােগদানকারী দেশগুলির দৈনিক ব্যয় ছিল ২৪ কোটি ডলার এবং যুদ্ধে মােট ব্যয় হয়েছিল ২৭ হাজার কোটি ডলার। তাছাড়া সমুদ্রে জাহাজ ও জাহাজ পণ্য ডুবিয়ে মূল্যবান ধাতু নষ্ট করে যে বিপুল পরিমাণ সম্প ধ্বংস করা হয় তার হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি।

 

2)  সৈনিকদের প্রাণহানি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি সেনা অংশ নেয়, যার মধ্যে ১ কোটি ৩০ লক্ষ সেনা মারা যায়। ২ কোটির বেশি সেনা আহত হয় এবং এদের মধ্যে ৭৯ লক্ষ সেনা পঙ্গু হয়ে যায়। হতাহতদের ২/৩ অংশই ছিল মিত্রপক্ষের সেনা। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে রাশিয়ার।

 

৩) অসামরিক লােকের মৃত্যু : সামরিক আক্রমণ, যুদ্ধজনিত খাদ্যাভাব, মহামারি প্রভৃতির ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের চেয়ে অনেক বেশি অসামরিক লােক প্রাণ হারায়। ফলে বহু দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার খুব কমে যায়। অনেক বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীও যুদ্ধে প্রাণ হারান। ইংরেজ কবি উইলফ্রেড ওয়েন এই যুদ্ধে নিহত হন।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গভীর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল লক্ষ করা যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল:

১) গণতন্ত্রের প্রসার : যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরােপে গণতন্ত্রের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ডেভিড টমসন বলেছেন যে, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গণতন্ত্রই জয় হয়।” ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপে ৫টি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, এই সংখ্যা বেড়ে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে দাঁড়ায় ১৬টি।

 

২)  জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে (১৯১৯ খ্রি.) জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে এক জাতি, এক ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে।

 

৩) ক্ষয়ক্ষতি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অন্তত ১ কোটি ৩০ লক্ষ সৈনিতে মৃত্যু হয়। অসামরিক লােকের হতাহতের সংখ্যা আরও বহু বেশি। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির দৈনিক ব্যয় ছিল ২৪ কোটি ডলার এবং যুদ্ধে মােট ২৭ হাজার কোটি ডলার অর্থ ব্যয়িত হয়। জনবল ও অর্থবলের অভাবে যুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে দুর্দশা দেখা দেয়।

 

৪)  একনায়কতন্ত্রের প্রসার : যুদ্ধের পর গণতন্ত্রের প্রসারের পাশাপাশি জার্মানি, ইটালি, রাশিয়া, তুরস্ক, স্পেন প্রভৃতি দেশে

একনায়কতন্ত্রেরও প্রসার ঘটে। যুদ্ধ-পরবর্তী খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রের প্রসারের পথ তৈরি করে।

 

৫) জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা : বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ‘চোদ্দো দফা নীতি’র ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ’ বা ‘লিগ অব নেশ’ নামে এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়।

 

 ৬) শক্তিকেন্দ্রের পরিবর্তন : বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ছিল ইউরােপের প্রধান শক্তিশালী দেশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হয় এবং ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি জয়ী হলেও তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে তাদের পূর্ব গৌরব ও ক্ষমতা ধ্বংস হয় এবং আমেরিকা ও রাশিয়া বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

 

৭) সামাজিক পরিবর্তন: যুদ্ধে অগণিত যুবকের মৃত্যুর ফলে শিল্পকারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাজে প্রচুর মেয়ে নিযুক্ত হয়। ফলে মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। এসময় শ্রমিকশ্রেণিরও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *