ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তি এবং ক্যাবিনেটের গঠন ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলােচনা কর
ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তি এবং ক্যাবিনেটের গঠন ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলােচনা কর।
ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তি
উত্তর।
তত্ত্ব ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ব্রিটেনের রাজা বা রানীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ব্যাপারে এই উক্তিটি সবচেয়ে বেশি প্রযােজ্য। তত্ত্বগতভাবে ইংল্যান্ডের রাজা বা রানী বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে তার ক্ষমতাগুলি আনুষ্ঠানিক মাত্র। রাজা বা রানী নিয়মতান্ত্রিক শাসকমাত্র।
রাজা বা রানী তত্ত্বগতভাবে যে বিপুল ক্ষমতা ভােগ করেন, তার উৎস হল প্রধানত দুটি, যথা- (১) রাজশক্তির বিশেষাধিকার (Prerogatives of the crown) এবং (২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইন।
রাজার বিশেষাধিকার বলতে রাজার সেই সব ক্ষমতাগুলিকে বােঝায় যেগুলির ভিত্তিতে অন্যান্য সকলের ওপর রাজার বিশেষ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত এবং যেগুলি প্রথাগত আইনের বহির্ভূত। ডাইসির মতে, কোন নির্দিষ্ট সময়ে স্ববিবেচনা বা স্বেচ্ছাধীনভাবে কাজ করবার আইনগত ক্ষমতার যে অবশিষ্টাংশ রাজশক্তির হস্তে ন্যস্ত থাকে তাকেই বিশেষাধিকার বলে। পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের মাধ্যমে রাজা যে সমস্ত ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন সেগুলি নিম্নলিখিত
◆ ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা হল :
(১) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা : ব্রিটিশ সরকারের যাবতীয় শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা রাজা বা রানীর হস্তে অর্পিত হয়েছে। রাজা হলেন ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। শাসনবিভাগীয় ক্ষমতাগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল : (ক) দেশের আইনসমূহ ঠিক ঠিক ভাবে কার্যকর হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করা ; (খ) মন্ত্রিগণকে, উচ্চপদস্থ কর্মচারী, বিচারপতি, নৌবাহিনী, স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের নিয়ােগ করা অথবা পদচ্যুত করা; (গ) বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা করা, কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের নিয়ােগ করা, বিদেশে প্রেরণ করা ; (ঘ) প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা; (ঙ) যুদ্ধ ঘােষণা ও শান্তি স্থাপন করা ; (চ) কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির মধ্যে যােগসূত্র হিসাবে কাজ করা ইত্যাদি।
(২) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাজা বা রানী শুধু শাসন বিভাগের প্রধান •ন, আইন বিভাগেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটেনের পার্লামেন্টকে রাজা বা রানীসহ পার্লামেন্ট (King or Queen in IParliament) বলা হয়। রাজার আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : (ক) পার্লামেন্ট প্রণীত বিল অনুমােদন করা অথবা নাকচ করা ; (খ) পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করা, স্থগিত রাখা, প্রয়ােজনে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়া ; (গ) প্রতি আর্থিক বছরের শুরুতে পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া রাজা বা রানী কয়েকটি উপনিবেশ সম্পর্কে স-পরিষদ রাজা (Order-in-Council) অনুযায়ী আইন প্রণয়নের অধিকার ভােগ করেন।
ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তি এবং ক্যাবিনেটের গঠন ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলােচনা কর।
(৩) বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা: বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারেও রাজার ক্ষমতা অসীম। বলা হয় রাজা সকল ন্যায়বিচারের উৎস (Fountain of all justice)। ইংল্যাণ্ডের সব আদালতই রাজার আদালত বলে পরিচিত এবং রাজার প্রণীত আইন অনুসারেই আদালত বিচারকার্য সম্পাদন করে। সর্বস্তরে বিচারপতিদের নিয়ােগ করা, আদালতের দণ্ডাদেশ মুকুব করা প্রভৃতি রাজার বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। রাজা ন্যায় বিচারের উৎস বলে রাজার বিরুদ্ধে আদালতে কোন মামলা রুজু করা যায় না।
(8) অন্যান্য ক্ষমতা : যুক্তরাজ্যে রাজশক্তিকে সম্মানের উৎস’ (Fountain of Honours) বলা হয়। রাজা বা রানী সম্মানসূচক বিভিন্ন উপাধি বা খেতাব বিতরণ করেন। এছাড়া রাজা বা রানী ইংল্যাণ্ডের গীর্জাগুলির প্রধান হিসাবে গণ্য হন। ঐ দেশের প্রধান যাজক ও অন্যান্য যাজকগণকে রাজাই নিয়ােগ করেন।
◆ ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তির ভূমিকা ও পদমর্যাদা :
উপরােক্ত ক্ষমতাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে রাজা বা রানীকে আপাত- -দৃষ্টিতে একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান বলে মনে হতে পারে। সামাজিকভাবে এবং উৎসবাদির ব্যাপারে রাজার গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় কিছুই কমে নি। কিন্তু বাস্তবে তিনি একটি ক্ষমতাহীন মহামহিম’ (His Superfluous Highness) বা জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগােপাল’ (Magnificent Cipher) মাত্র। আইনগত ভাবে যে সমস্ত ক্ষমতা রাজার হস্তে ন্যস্ত করা হয়েছে, সেগুলির কোনটিই তিনি নিজের ইচ্ছায় ব্যবহার করতে পারেন না। বাস্তবে রাজশক্তির সমস্ত ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন মন্ত্রিগণ। উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ােগ, যুদ্ধ ঘােষণা, শান্তি স্থাপন, চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি রাজার ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত হলেও মন্ত্রিসভার পরামর্শ ব্যতীত তিনি এইসব ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন না। রাজা বা রানীর পার্লামেন্ট প্রণীত বিলে সম্মতি প্রদান একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাপার মাত্র। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ১৭০৭ সালের পর রাজা বা রানী পার্লামেন্ট প্রণীত কোন বিলে স্বাক্ষর দানে অসম্মতি জানান নি।
রাজা বা রানীকে সর্বপ্রকার ন্যায় বিচারের উৎস বলে মনে করা হলেও বাস্তবে দেখা যায় পার্লামেন্ট কর্তৃক বিধিবদ্ধ আইনের ভিত্তিতে ব্রিটেনে আদালত গঠিত হয় এবং বিচার কার্য সম্পাদিত হয়।
একসময় রাজা যে ব্যাপক বিশেষাধিকার ভােগ করতেন, বর্তমানে তার সামান্য অবশিষ্টাংশ রয়েছে। তাও আবার মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী ঐগুলি ব্যবহৃত হয়।
এক কথায় রাজা যা কিছু করেন তা মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমেই। রাজার এই নিয়মতান্ত্রিক ভূমিকার উল্লেখ করে লর্ড ঈশার (Esher) বলেছেন, মন্ত্রীরা রাজাকে যদি নিজের মৃত্যুদন্ডাজ্ঞায় স্বাক্ষর করতে পরামর্শ দেন, তখনও রাজাকে সেই পরামর্শ মেনে চলতে হবে।” রাজার এই ক্ষমতাহ্রাস লক্ষ্য করে লাওয়েল মন্তব্য করেছেন, “As political organ the crown has receded to the background.”
তবে কেউ কেউ রাজা বা রানীকে পুরােপুরি জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগােপাল’ হিসাবে মেনে নিতে রাজী নন। এঁদের মতে, সাধারণ অবস্থায় রাজাকে মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয় সত্য, কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি স্ববিবেক অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। যেমন
প্রথমতঃ, সাধারণ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নিয়ােগের ব্যাপারে রাজার বিশেষ কিছু করার থাকে না। কারণ, কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়ােগ করতে বাধ্য থাকেন। কিন্তু নির্বাচনে যদি কোন দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কোন অবিসংবাদিত নেতা না থাকেন, সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের ব্যাপারে রাজা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন।
দ্বিতীয়তঃ, এক মন্ত্রিসভার প্রস্থান ও অন্য মন্ত্রিসভার কার্যভার গ্রহণের অন্তবর্তী সময়ে শাসন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, রাজা বা রানী তা পূরণ করে রাজনৈতিকক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়ােজনীয় ভূমিকা পালন করেন।
তৃতীয়তঃ, দেশের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বিরােধ মীমাংসার ক্ষেত্রেও রাজা বা রানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। রাজনীতি-নিরপেক্ষ রাজার সালিসি মেনে নিতে বিবদমান কোন পক্ষেরই আপত্তি থাকে না।)১৯১৪ সালে আয়ার্ল্যান্ডের স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার সম্পর্কে গুরুতর মতভেদ দেখা দিলে রাজা পঞ্চম জর্জ ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার করে জাতিকে ঐ সংকট থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছিলেন।
চতুর্থতঃ, বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির মধ্যে যােগসূত্র রক্ষা করার ক্ষেত্রে রাজার ভূমিকা অনবদ্য।
পঞ্চমতঃ, বেজহট (Bagehot) রাজার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ করছেন, যথা——(১) পরামর্শ দেবার, (২) উৎসাহ দেবার এবং (৩) সতর্ক করার (“The crown has three rights, the right to be consulted, to right to encourage and the right to warn”.)
◆ ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা উপসংহার-
রাজার প্রকৃত ভূমিকার সমর্থনে যা কিছু বলা হােক না কেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্রিটেনের রাজনীতিতে রাজশক্তির ভূমিকা নগণ্য। তিনি মাজত্ব করেন (reigns), কিন্তু শাসন (govern) করেন না। তিনি ভাল ভাবেই জানেন, যে মুহূর্তে তিনি মন্ত্রিসভার ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন, সেই মুহূর্তে তিনি অনিবার্যভাবে এক অবাঞ্ছিত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়বেন এবং রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে যে একটা সুখকর সহাবস্থান গড়ে উঠেছে তা অন্তর্হিত হবে। তিনি আরও জানেন, এই সংঘর্ষে গণতন্ত্রের জয় এবং রাজতন্ত্রের পরাজয় তথা বিলােপ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে।
তবে রাজা যদি যোগ্য ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হন, তাহলে এখনও ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। লাওয়েলের (Lowell) সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায়, বর্তমানে রাজা ক্ষমতা হারিয়েছেন, কিন্তু প্রভাব হারান নি (Influence has substituted for power.)!
■ ইংল্যাণ্ডের ক্যাবিনেট ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা কর।
উত্তর। ব্রিটেনে মন্ত্রিপরিষদচালিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত আছে। এই শাসনব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছেন রাজা বা রানী। তিনি নামসব শাসক মাত্র। দেশের প্রকৃত শাসনক্ষমতা ন্যস্ত থাকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার হাতে। মন্ত্রিসভা বা ক্যাবিনেটের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে আলােচনা কবা হল :
(১) আইনগত ভিত্তির অভাব : ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী সংস্থা হল ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভা। অথচ এই ক্যাবিনেটের কোন আইনগত ভিত্তি নেই। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত প্রথা ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে ব্রিটেনেব ক্যাবিনেট
ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ১৯৩৭ সালের রাজমন্ত্রী আইনে (Ministers of the Crown Act, 1937) ক্যাবিনেট প্রথম আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে।
(২) নিয়মতান্ত্রিক শাসকের অবস্থিতি: এই শাসনব্যবস্থায় রাজা বা রানী হলেন নিয়মতান্ত্রিক শাসক, আর প্রকৃত শাসক হলেন মন্ত্রিসভা। আইনগতভাবে সমস্ত ক্ষমতা রাজা বা রানীর হাতে ন্যস্ত থাকলেও, তিনি সেইসব ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী। তিনি রাজত্ব করেন, কিন্তু শাসন করেননা। শাসন করেন মন্ত্রিসভা।
(৩) ক্যাবিনেট সদস্যরা পার্লামেন্টের সদস্য : ক্যাবিনেট হল পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্যাবিনেটের সদস্যদের অতি অবশ্যই পার্লামেন্টের যে কোন কক্ষের সদস্য হতে হবে। পার্লামেন্টের সদস্য নয় এমন কোন ব্যক্তি যদি ক্যাবিনেটের সদস্য হন তাহলে তাকে ছয় মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের সদস্যপদ অর্জন করতে হবে। অন্যথায় তাঁকে ক্যাবিনেট থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
(৪) সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি : কমন্স সভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের সদস্যদের মধ্য থেকে ক্যাবিনেট-সদস্যদের নিয়ােগ করা হয়। অর্থাৎ ব্রিটেনের ক্যাবিনেট-সদস্যগণ সাধারণত একই রাজনৈতিক দলভুক্ত। একই রাজনৈতিক দল থেকে মন্ত্রিগণ নিযুক্ত হন বলে তারা সমদৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হয়ে থাকেন। অবশ্য যুদ্ধ অথবা জরুরি অবস্থায় সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১৯১৬, ১৯৩০ এবং ১৩৪০ সালে এই ধরনের সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছিল।
(৫) সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীই প্রধানমন্ত্রী : কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়ােগ করেন। তবে কমসভায় কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে রাজা বা রানী নিজ বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করতে পারেন। ১৯২৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে রাজা উদারনৈতিক দলের নেতা এ্যাসকুইথের পরিবর্তে শ্রমিক দলের নেতা ম্যাকডােনাল্ডকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানান।
(৬) ক্যাবিনেট গঠনে প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য : তত্ত্বগতভাবে ক্যাবিনেটের সদস্যদের নিয়ােগ করেন রাজা বা রানী, কিন্তু বাস্তবে এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই ঠিক করেন কোন্ কোন্ সদস্যকে ক্যাবিনেট মন্ত্রী করা হবে, কোন্ মন্ত্রীকে কোন্ দপ্তর দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে দপ্তর পুনর্বণ্টন করতে পারেন।
ক্যাবিনেটের সকল সদস্য সমমর্যাদাসম্পন্ন হলেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও প্রাধান্য একটি স্বীকৃত ঘটনা। তাঁকে ভিত্তি করেই ক্যাবিনেটের যাবতীয় কাজ পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোন মন্ত্রীর বিরােধ বাধলে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ক্যবিনেটের ওপর প্রধানমন্ত্রীর এই অপ্রতিহত প্রাধান্য লক্ষ্য করে অনেকে তাঁকে ক্যাবিনেট তােরণের প্রধান স্তম্ভ বলে বর্ণনা করে থাকেন।
(৭) আইনবিভাগ ও শাসন কিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক : ক্যাবিনেট ব্যবস্থায় আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, কারণ আইনবিভাগের সদস্যদের মধ্যে থেকেই ক্যাবিনেট-সদস্যদের নিয়ােগ করা হয়। ক্যাবিনেট সদস্যরা পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত বিতর্কে, ভােটভুটিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। অধিকাংশ আইনের প্রস্তাব ক্যাবিনেট-সদস্যরাই তৈরি করেন এবং আইনসভায় পেশ করেন। আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় শাসনবিভাগের পক্ষে প্রয়ােজনীয় আইন পাশ করা সহজ হয়।
(৮) মন্ত্রীদের দায়িত্বশীলতা : ব্রিটিশ ক্যাবিনেট ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল কমন্স-সভার নিকট মন্ত্রীদের দায়িত্বশীলতা। এই দায়িত্বশীলতা দু’ধরনের ব্যক্তিগত এবং যৌথ। ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতার অর্থ হল প্রত্যেক মন্ত্রী তাঁর কাজের জন্য কমন্সসভার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য। তিনি অন্য কারুর ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন না। আর যখন শাসনকার্য পরিচালনার কোন ত্রুটির জন্য সামগ্রিকভাবে ক্যাবিনেটকে কমন্সসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়, তখন সেই দায়িত্বশীলতাকে যৌথ দায়িত্বশীলতা বলা হয়।
ক্যাবিনেটে একবার কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কোন মন্ত্রী সেই সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করতে পারবেন না। একান্তই কোন সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেই পদত্যাগ করতে হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘােষণার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে না পারার জন্য লর্ড মর্লি ও মিঃ বার্ণকে পদত্যাগ করতে হয়। কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে সমগ্র ক্যাবিনেটকে পদত্যাগ করতে হয়।
(৯) ঐক্য ও সংহতি : কমন্সসভার নিকট যৌথ দায়িত্বশীলতার কারণে মন্ত্রীদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা একান্ত জরুরি। সরকারী নীতি সম্পর্কে ঐকমত্য না থাকলে ক্যাবিনেট যৌথ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। ক্যাবিনেটের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু কোন একটি বিষয়ে ক্যাবিনেটে একবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেলে প্রতিটি সদস্যকে সেই সিদ্ধান্তের সপক্ষে দৃঢ় সমর্থন জানাতে হয়। এই একতাই হল ক্যাবিনেট ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লর্ড মেলবাের্ন বলেছিলেন, “আমরা যা বলি তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু আমরা যা বলি তা ঐক্যবদ্ধভাবে বলি” (“It does not in the least matter what we say but we must all say the same”.) i
(১০) গােপনীয়তা : ক্যাবিনেটের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এর বৈঠকের গােপনীয়তা বজায় রাখা। ক্যাবিনেট বৈঠকের আলাপ-আলােচনায় যে সকল মতপার্থক্য দেখা দেয় সে বিষয়ে প্রত্যেক মন্ত্রীকেই গােপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। মন্ত্রীদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি রক্ষার প্রয়ােজনেই এই গােপনীয়তা রক্ষা করা দরকার। তাছাড়া দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেও এই গােপনীয়তার প্রয়ােজন আছে।
■ ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলি কি ?
উত্তর।
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্রিটেনে এখনও রাজতন্ত্র টিকে থাকার ব্যাপারটি বিস্ময়ের। বিস্ময় এই কারণে যে, প্রথমতঃ ব্রিটেনে রাজতন্ত্র জন্ম নিয়েছিল সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ হিসাবে। বর্তমানে ব্রিটেনে সামন্ততন্ত্রের বিলােপ হয়েছে, পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে, অথচ রাজতন্ত্র অটুট রয়ে গেছে।
দ্বিতীয়তঃ, বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছে বা হচ্ছে, সেখানে ব্রিটেন ‘গণতন্ত্রের পীঠস্থান হয়েও রাজতন্ত্রকে অব্যাহত রেখেছে।
তৃতীয়তঃ, বর্তমানে রাজা বা রানী একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক মাত্র। ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাঁর কোন কার্যকরী ভূমিকা নেই বললেই চলে। অথচ এই আড়ম্বরপূর্ণ ও ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানটিকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। আরও বিস্ময়ের, ১৯৫৭ সালে লর্ড অ্যালট্রিনচান (Lord Altrinchan) রাজতন্ত্রের ন্যায় অগণতান্ত্রিক, ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানটিকে উচ্ছেদের প্রস্তাব করলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠে যায়। এখন দেখা যাক ইংল্যাণ্ডে রাজতন্ত্রটিকে থাকার নিগূঢ় রহস্যটি কি !
স্যার আইভর জেনিংস ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার পশ্চাতে চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন : (১) রাজা বা রানী শাসনতন্ত্রকে ধরে রেখেছেন ; (২) তঁাকে কেন্দ্র করেই কমনওয়লেথ ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে; (৩) তিনি কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন ; এবং (৪) রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বাইরেও তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।
● ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার পশ্চাতে আরও যেসব যুক্তি
(১) রক্ষণশীলতা : ইংরেজ জাতি অত্যন্ত রক্ষণশীল ; আর এই রক্ষণশীলতার জন্যই রাজতন্ত্রের মত একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে আজও তারা রক্ষা করে আসছেন। এই রক্ষণশীল চরিত্র শেষবারের মত প্রকাশ পায় ১৯৫৭ সালে লর্ড অ্যালট্রিনচান (Altrinchan) রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করার প্রস্তাব করলে। বস্তুতঃ সারা দেশ এই প্রস্তাবের বিরােধিতায় মুখর হয়ে ওঠে।
খাড়া করা হয় সেগুলি হল :
(২) গণতন্ত্রের বিরােধী নয় : ব্রিটেনে গণতন্ত্র ও সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশে রাজতন্ত্র কখনও বাধা সৃষ্টি করে নি, বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খুব অদ্ভুতভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এই কারণে এই প্রতিষ্ঠানটিকে উচ্ছেদ করার কোন প্রয়ােজন অনুভূত হয় নি। অধ্যাপক বার্কার যথার্থই বলেছেন, The monarchy has survived because it has changed and because it has moved with the movement of time”.
(৩) সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার প্রয়ােজনীয় অঙ্গ : সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল একটি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রধানের অবস্থিতি। ব্রিটেনে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এখানে একজন নামসর্বস্ব শাসকের প্রয়ােজন। রাজতন্ত্র সেই প্রয়ােজন মেটায়। ব্রিটেনে যদি রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা হয়, তাহলে শাসনকার্যে বাবাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ভারতের ন্যায় একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদ সৃষ্টি কবতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানকে আসতে হবে বলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই দলের উর্ধ্বে উঠতে পারবেন না। সুতরাং সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্ণে ব্রিটেনে রাজনীতি নিরপেক্ষ বাজদের অস্তিত্বই অধিক সুবিধাজনক।
(৪) রাজপদের ব্যবহারিক মূল্য : ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজপদের ব্যবহারিক মূল্যকেও অস্বীকার করা যায় না। এক মন্ত্রিসভার প্রস্থান ও অন্য মন্ত্রিসভার কার্যভার গ্রহণের অন্তবর্তী সময়ে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, রাজা বা রানী তা পূরণ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একজন রাজা বা রানীর রাজত্বকালে বহু মন্ত্রিসভার উত্থান-পতন ঘটে; দেশ বহু জটিল ও সংকটজনক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সমস্ত পরিস্থিতি মােকাবিলার ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তব ফলাফল সম্পর্কে রাজা বা রানী ওয়াকিবহাল থাকেন।
এইভাবে তিনি যে বিপুল অভিজ্ঞতার অধিকারী হন, সেই অভিজ্ঞতা কোন প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর থাকে না। বার্কার বলেছেন : “The continuous tenure of a life-office makes a king a central source of a long time experience’ রানী ভিক্টোরিয়া ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ অর্থাৎ ৬৪ বছর রাজত্ব করেন। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে জাত রাজা বা রানীর পরামর্শ দেশের অনেক মৌলিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।
(৫) ব্যয় বহুল নয় : ব্রিটেনের রাজপদ টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারী কোষাগার থেকে অর্থব্যয় হয় ঠিকই, কিন্তু এর জন্য দেশের মােট রাজস্বের মাত্র ১ ভাগ খরচ হয়। রাজপদের উপযােগিতার তুলনায় এই ব্যয় যৎসামান্য। আর তাছাড়া রাজপদ বংশানুত্রিক হওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ নির্বাচনী ব্যয় বেঁচে যায়।
(৬) জাতীয় ঐক্যের প্রতীক : ব্রিটেনের রাজা বা রানী জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসাবে কাজ করেন। রাজা কোন বিশেষ দলের নন, কোন বিশেষ শ্রেণীর নন, কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের নন, তিনি সর্বসাধারণের রাজা। এই অনুভূতি ইংরেজদের মধ্যে দেশপ্রেমের সৃষ্টি করে। জেনিংস (Jennings) বলেছেন : “A monarchy provides a useful focus of patriotism”. যুদ্ধ বা অন্য কোন জাতীয় সংকটে রাজা বা রানীর আবেদন জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে এবং দেশবাসীর মনে গভীর উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
(৭) কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির মধ্যে যােগসূত্র : রাজশক্তি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির মধ্যে প্রধান যােগসূত্র হিসাবে কাজ করে। কমনওয়েলথভুক্ত সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারত সহ অনেকেই রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে না, কিন্তু কমনওয়েলথের প্রধান হিসাবে রাজা বা রানীকে মেনে নিতে আপত্তি করে না। এজন্যই রাজা বা রানীকে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ঐক্যের প্রতীক (Symbol of unity) বলে মনে করা হয়।
(৮) মনস্তাত্ত্বিক কারণ : যুক্তরাজ্যের মানুষের কাছে রাজা বা রানী পিতামাতা ও ঈশ্বরের ন্যায়। ব্রিটিনের সাধারণ মানুষের কাছে তিনি সমস্ত আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল। ইংল্যাণ্ডে একটি প্রবাদ চালু আছে, “বাকিংহাম রাজপ্রাসাদে রাজা বা রানী আছেন বলেই জনসাধারণ নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতে পারে।”
(৯) বৈচিত্র্যের উৎস : শিল্পসমৃদ্ধ ব্রিটেনে সাধারণ মানুষের জীবন খুবই যান্ত্রিক, কটিনাফিক এবং বৈচিত্র্যহীন। বাজা বা বাণীব মহাসমারােহে সিংহাসন আরােহণ, রাজপরিবারের জাব/জমকপূর্ণ বিবাহ ইত্যাদি বাহ্যাড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি জাসাধারণের বৈচি এই জীবনে নহেব স্বাদ এনে দেয়।
(১০) রাজপদের জনপ্রিয়তা : যুক্তরাজে’ রাজপদটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন সময় জামত সংগ্রহ করে দেখা গেছে যে, ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষই রাজতত্ত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে। যেমন ১৯৮৩ সালে সংগৃহীত একটি নমুন! হােটে দেখা যায় যে, শতকরা ৯৩ জন ব্রিটিশ নাগরিকের মতে রাজশক্তি একটি অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৯ সালের সংগৃহীত নমুনাভােটে এই সংখ্যাটা কমলেও শতকরা ৫৮ জন এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ব্রিটেনে রাজপদ তুলে দিলে দেশের ক্ষতি হবে।
(১১) দেশপ্রেমের জাগরণ : জেনিংস প্রমুখ সংবিধান-বিশেষজ্ঞের মতে, ব্রিটেনের রাজতন্ত্র দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক হিসাবে কাজ করে। দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থাকার জন্য ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণ রাজা বা রানীকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দে•ে ; আর এই অখণ্ড আনুগত্যই দেশপ্রেম বৃদ্ধির সহায়ক বলে অনেকে মনে করেন। যুদ্ধ বা সংকটকালীন অবস্থায় জনসাধারণের রাজশক্তির আবেদন তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগরিত করে।
কাছে ওপরের আলােচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের ভিত আজও যথেষ্ট মজবুত। সেখানে লর্ডসভা বিলােপের দাবি কখনও খাও শােনা যায়, কিন্তু রাজতন্ত্র উচ্ছেদের দাবি খুবই বিরল। অনেকে বলেন, শাসকশ্রেণী নিজের স্বার্থে রাজশক্তিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা রাজার জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে দেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের গতিরােধ করে থাকে। অধ্যাপক বার্কারের মতে, It (monarchy) helps to prevent revolutionary dreams and sensational changes”. ,
■ ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের গঠন কার্যাবলী ও গুরুত্ব আলোচনা করো
“ক্যাবিনেট রাজনৈতিক তােরণের মধ্যপ্রস্তর”—ইংল্যাণ্ডের ক্যাবিনেটের কার্যাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে উক্তিটি আলােচনা কর।
উত্তর।
ব্রিটেনে মন্ত্রিপরিষদচালিত শাসনব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। এই শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। মন্ত্রিসভার আবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ক্যাবিনেট। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় ক্যাবিনেট যে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর উক্তি থেকেও ক্যাবিনেটের গুরুত্ব সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন লাওয়েল (Lowell) বলেছেন, “ক্যাবিনেট হল রাজনৈতিক তােরণের মধ্যপ্রস্তর” (Keystone of the political arch)। রামেসে মুর (Ramsay Muir) ক্যাবিনেটকে “রাস্ট্ররূপ জাহাজের চালনীচক্র” (Steering wheel of the ship of the state) বলে বর্ণনা করেছেন।
ক্যাবিনেটের গঠন;
ক্যাবিনেট হল মন্ত্রিসভার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র আয়তনবিশিষ্ট সংস্থা। মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই সংস্থা গঠিত হয়। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য নিয়ে ক্যাবিনেট গঠিত হয়। যুদ্ধ বা অন্যান্য জরুরি অবস্থায় এর আকৃতি আরও ছােট হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে চার্চিলের যুদ্ধকালীন ক্যাবিনেটের সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫। পরে এই সংখ্যা বেড়ে আট হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় যেসব ক্যাবিনেট গঠিত হয় তার মধ্যে ক্ষুদ্রতম ছিল ১৯২২ সালের বােনার ল (Bonar Law)-এর ক্যাবিনেট, যার সদস্য ছিল ১৪ জন। আর বৃহত্তম ক্যাবিনেট ছিল ১৯৬৪ সালের প্রধানমন্ত্রী উইলসনের ক্যাবিনেট, যার সদস্য ছিল ২৪ জন।
ক্যাবিনেট মন্ত্রিগণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী কর্তৃক নিযুক্ত হন। ক্যাবিনেটের সদস্যদের পার্লামেন্টের সদস্য হতে হয়। পার্লামেন্টের সদস্য নয় এমন কোন ব্যক্তি ক্যাবিনেট-সদস্য হলে তাকে অনতিবিলম্বেই পার্লামেন্টের সদস্য হতে হয়। অনেক সময় এঁদের লর্ড উপাধি প্রদান করে লর্ডসভার সদস্য করে দেওয়া হয়।
সাধারণত প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে ক্যাবিনেট সভা বসে। তবে অন্যদিন বা অন্য সময়ও ক্যাবিনেটের সভা বসতে পারে। ক্যাবিনেট সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী।
ক্যাবিনেটের কার্যাবলী : ক্যাবিনেটের কার্যবলীকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগ করে আলােচনা করা হল :
(১) নীতি-নির্ধারণ : জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণই হল ক্যাবিনেটের প্রধান কাজ। হার্ভে এবং ব্যাথার যথার্থই বলেছেন, “The Cabinet is the real policy-forming body in the British Constitution.” সাধারণত ক্ষমতাসীন দল তাদের ঘােষিত দলীয় নীতি অনুসারে সরকারী নীতি নির্ধারণ করে। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্যাবিনেটের সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তা বাইরে প্রকাশিত হয় না। রাজা বা রানী পার্লামেন্টে যে “রাজকীয় বক্তৃতা দেন, তা ক্যাবিনেট কর্তৃক রচিত হয় এবং এর মধ্যে সরকারের মৌলিক নীতিসমূহ লিপিবদ্ধ থাকে।
ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় রাজশক্তি এবং ক্যাবিনেটের গঠন ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলােচনা কর।
(২) আইন প্রণয়ন:
নির্ধারিত নীতিগুলি সুষ্ঠুভাবে প্রয়ােগের জন্য মন্ত্রিপরিষদকে প্রয়ােজনীয় আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নিতে হয়। তত্ত্বগতভাবে আইন প্রণয়নের কাজ পার্লামেন্টের। কিন্তু বাস্তবে ক্যাবিনেটই এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নেয়। কোন্ কোন্ বিষয়ের ওপর আইন প্রণয়ন করা হবে তা ক্যাবিনেট স্থির করে। অধিকাংশ আইনের খসড়া ক্যাবিনেটের নির্দেশেই রচিত হয় এবং অধিকাংশ আইনের প্রস্তাব ক্যাবিনেটের সদস্যগণ কর্তৃক পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়। পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ক্যাবিনেট গঠিত হয় বলে ক্যাবিনেটের দ্বারা প্রস্তাবিত বিলকে পার্লামেন্টের মধ্যে অবস্থিত দলের সাধারণ সদস্যরা বিরােধিতা করতে সাহস পায় না।
এছাড়া বর্তমানে কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা সম্প্রসারিত হওয়ার জন্য আইনসভাকে প্রচুর আইন তৈরি করতে হয়। বিভিন্ন দিক খুঁটিনাটি বিবেচনা করে বিভিন্ন বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার মত সামর্থ্য ও সময় পার্লমেন্টের থাকে না। তাই পার্লামেন্ট আইনের মূল রূপরেখাটি অনুমােদন করে বাকি খুঁটিনাটি বিষয় বিবেচনা করে আইনটিকে পূর্ণতাদানের ক্ষমতা ক্যাবিনেট তথা মন্ত্রিসভার ওপর অর্পণ করা হয়। এই ক্ষমতা বলে ক্যাবিনেট যে আইন প্রণয়ন করে তাকে ‘অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন’ বলে।
এক কথায় বলা যায়, বর্তমানে পার্লামেন্টের পরিবর্তে ক্যাবিনেটই আইন প্রণয়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। অগ এবং জিঙ্ক এজন্যেই বলেছেন, “Now-a-days it is the Cabinet that legislates with the advice and consent of Parliament.”
(৩) শাসনবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ : দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ক্যাবিনেটের অপর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ক্যাবিনেট কর্তৃক সমর্থিত নীতি এবং পার্লামেন্ট-প্রণীত আইনের ভিত্তিতে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করা ক্যাবিনেটের দায়িত্ব। তত্ত্বগতভাবে শাসনবিভাগের যাবতীয় ক্ষমতা রাজা বা রানীর হাতে ন্যস্ত হলেও বাস্তবে তিনি ক্যাবিনেটের পরামর্শ অনুযায়ী ঐসব কার্য পরিচালনা করেন। বর্তমানে অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইনের প্রসার ঘটায় ক্যাবিনেটের শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন মন্ত্রীকে তার দপ্তরের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে ক্যাবিনেটের পরামর্শ নিতে হয়।
(৪) বাজেট প্রণয়ন : সরকারের আয়-ব্যয় নির্ধারণের ব্যাপারেও ক্যাবিনেটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক বাজেটের খসড়া কমন্স সভায় পেশ করার আগে সে বিষয়ে ক্যাবিনেটে আলােচনা হয়। ক্যাবিনেটের অনুমােদন ও রাজা বা রানীর সম্মতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেটটি পেশ করেন কমন্সসভায়।
(৫) সমন্বয় সাধন : সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার দায়িত্ব ক্যাবিনেটের। এই কাজটি ঠিকভাবে না হলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি, পারস্পরিক রেষারেষি ইত্যাদি বাড়বে এবং শাসনকার্যে ব্যাঘাত ঘটবে। বর্তমানে এই সমন্বয় সাধনের কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য নেট একটি পৃথক দপ্তর গঠন করেছে।
(৬) পার্লামেন্টের কর্মসূচী রচনা :
ক্যাবিনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল পার্লামেন্টের কর্মসূচী রচনা করা। কোন্ কোন্ বিষয়ের ওপর আইন রচনার প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে, কোন্ প্রস্তাবের ওপর কে প্রধান বক্তা হবেন, এসব বিষয় ক্যাবিনেটই স্থির করে দেয়। এছাড়া পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করা, স্থগিত রাখা, প্রয়ােজনে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এগুলি রাজা বা রানীর নামে কার্যত ক্যাবিনেটই করে থাকে।
(৭) অন্যান্য কার্যাবলী : উপরােক্ত কাজগুলি ছাড়াও ক্যাবিনেটকে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করতে হয়, যেমন—সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগ, বদলি, পদোন্নতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া, সরকারী নীতি ঠিকমত প্রয়ােগ হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর দেওয়া, রাষ্ট্রদূতদের কাজের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া, উপনিবেশের শাসনকার্য পরিচালনা সম্পর্কে ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি।
● ক্যাবিনেটের গুরুত্ব :
উপরােক্ত আলােচনা থেকে একথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় ক্যাবিনেট অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ক্যাবিনেট ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার প্রধান চালিকাশক্তি, প্রধান নীতি নির্ধারণকারী সংস্থা, এককথায় প্রাণকেন্দ্র। ঊনবিংশ শতাব্দীর মর্যাদাসম্পন্ন পার্লামেন্ট বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে একটি শােভাবর্ধণকারী ও চাকচিক্যপূর্ণ ‘বিতর্ক সভায় পরিণত হয়েছে। ল্যাস্কি বলেন, ক্যাবিনেটের কাজকর্মকে নির্দ্বিধায় সমর্থন করাই এখন পার্লামেন্টের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্যাবিনেটের এই অস্বাভাবিক ক্ষমতাবৃদ্ধিকে রামসে মুর ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব’ (Dictatorship of the Cabinet) বলে অভিহিত করেছেন। হার্ভে এবং ব্যাথার ক্যাবিনেটের গুরুত্ব প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, বর্তমানে ক্যাবিনেট শুধু সরকারের শাসনবিভাগই নয়, ব্রিটেনের সমগ্র সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যে সঙ্গতি রক্ষা করে।
তারা আরও বলেন, ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় ক্যাবিনেট ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের বিকল্প হিসাবে কাজ করে। কারণ ক্যাবিনেটই আইনবিভাগ ও নির্বাচকমণ্ডলীর সাথে শাসন বিভাগের প্রত্যক্ষ যােগসূত্র স্থাপন করে। এই প্রসঙ্গে বেজহট বলেন, ক্যাবিনেট হল একটি সমন্বয় কমিটি, একটি সংযােগ চিহ্ন যা শাসনবিভাগ ও আইনবিভাগের মধ্যে সংযােগ রক্ষা করে | বর্তমানে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় ক্যাবিনেটের একনায়কত্বের ধারণাটি যতখানি
অনেকের মতে তাত্ত্বিক ততখানি বাস্তব নয়। বাস্তবে ক্যাবিনেটের জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্রশম্যান ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকে ক্যাবিনেট-চালিত শাসনব্যবস্থা না বলে “প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত শাসনব্যবস্থা” বলার পক্ষপাতী। অনেকক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রী আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে বিষয়টি ক্যাবিনেটকে জানান।
এই মতকে অনেকেই সমর্থন করেন না। ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের সদস্যগণ মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্যাবিনেটের সদস্যদের তুলনায় বেশি ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। তাই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সব সময় নিজের সিদ্ধান্ত ক্যাবিনেট সদস্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা তাদের মতামতকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। ক্যাবিনেটকে উপেক্ষা করার দায়ে প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে হয়।