পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক উদ্ভিদের পরিচয় দাও। এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করাে।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক উদ্ভিদের পরিচয় দাও। এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করাে।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক উদ্ভিদ এবং কৃষির বৈশিষ্ট্য
পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক উদ্ভিদ
যে সমস্ত উদ্ভিদ মানুষের প্রচেষ্টা ছাড়াই ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিকভাবে জন্মায় এবং বেড়ে ওঠে, তাদের স্বাভাবিক উদ্ভিদ বলে। পশ্চিমবঙ্গ ক্রান্তীয় সুমি জলবায়ুর অন্তর্গত হওয়ায় এখানকার স্বাভাবিক উদ্ভিদও ক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির। এ রাজ্যের স্বাভাবিক উদ্ভিদগুলিকে তাদের অবস্থান, শ, মাটির প্রকৃতি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে মােট পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলি হল—1. উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের , 2. উত্তরের তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলের উদ্ভিদ, 3. পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ, ৪. সমভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ, 5. বদ্বীপ অঞ্চলের উদ্ভিদ।
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের উদ্ভিদ
১.অবস্থান : দার্জিলিং, কালিম্পং এবং আলিপুরদুয়ার জেলাতে এইপ্রকারের উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। ঢালের প্রকৃতি অনুযায়ী এই জাতীয় উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে।
২. চিরহরিৎ উদ্ভিদ : পর্বতের নীচের দিকে প্রায় 1000 মিটার উচ্চতা পর্যন্ত চিরসবুজ উদ্ভিদের অরণ্য দেখা যায়। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান উদ্ভিদগুলি হল—শাল, সেগুন, শিশু, গর্জন, বাঁশ, বেত প্রভৃতি।
৩. নাতিশীতােয় অঞলের সরলবর্গীয় উদ্ভিদ : 1000 মিটার থেকে 3000 মিটার উচ্চতার মধ্যে নীচের দিকে বড়াে পাতার পর্ণমােচী এবং ওপরের দিকে সরু ও ছুঁচোলাে পাতার সরলবর্গীয় উদ্ভিদ দেখা যায়। এই অঞলের প্রধান প্রধান উদ্ভিদগুলি হল—ওক, ম্যাপল, পাইন, স, দেবদারু, বার্চ প্রভৃতি।
৪. আল্লীয় অঞ্চলের উদ্ভিদ : 3000 মিটার উচ্চতার ওপরে এই জাতীয় উদ্ভিদ দেখা যায়। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান উদ্ভিদগুলি হল—সিলভার পাইন, রডােডেনড্রন ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক উদ্ভিদ
2. উত্তরের তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলের উদ্ভিদ
১.অবস্থান : দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলার তরাই ও ডুয়ার্সের সমভূমি অঞ্চলে এই উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়।
২.বৈশিষ্ট্য: [i] এই উদ্ভিদের বনভূমি পর্বতের পাদদেশে গড়ে ওঠে। [ii] প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য চিরসবুজ উদ্ভিদ জন্মায়। [iii] প্রধান প্রধান উদ্ভিদ : শাল, সেগুন, খয়ের, বেত, বাঁশ ইত্যাদি এখানকার উল্লেখযােগ্য উদ্ভিদ।
3. পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ
১.অবস্থান: পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান, ঝাড়গ্রামের উত্তরমধ্যাংশ, বীরভূমের পশ্চিমাংশ এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের উত্তর পশ্চিমভাগে পর্ণমােচী গাছের বনভূমি দেখা যায়।
২. বৈশিষ্ট্য: [i] শুষ্ক শীতকালে এই বনভূমির বৃক্ষের পাতাগুলি ঝরে যায়। তাই এর নাম পর্ণমােচী বনভূমি বা মৌসুমি বনভূমি। [ii] এখানকার বনভূমি গভীর নয়।
৩. প্রধান প্রধান উদ্ভিদ : অর্জুন, শিমুল, শাল, পলাশ, মহুয়া প্রভৃতি এই বনভূমির উল্লেখযােগ্য উদ্ভিদ।
4. সমভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ
১.অবস্থান: উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদহ, মুরশিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি, নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান, হাওড়া, বীরভূম প্রভৃতি জেলার সমভূমি অঞ্চলে এই জাতীয় উদ্ভিদ দেখা যায়।
২. বৈশিষ্ট্য: [i] সমভূমিতে এই জাতীয় উদ্ভিদ তথা বনভূমি বিক্ষিপ্তভাবে দেখতে পাওয়া যায়, [ii] শুষ্ক শীতকালে এই অঞলের বেশিরভাগ গাছের পাতা ঝরে যায়। অর্থাৎ এগুলি পর্ণমােচী শ্রেণির উদ্ভিদ। [iii] এখানকার অধিকাংশ উদ্ভিদ মাঝারি উচ্চতাযুক্ত হয়। এখানকার বৃক্ষগুলির কাঠ শক্ত বলে জানালা-দরজা, আসবাবপত্র প্রভৃতি তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত হয়। [iv] ঘন জনবসতি ও কৃষিকাজের জন্য এখানকার অধিকাংশ বনভূমি কেটে ফেলা হয়েছে।
৩. প্রধান প্রধান উদ্ভিদ; বট, আম, তেঁতুল, বেল, জাম, অশ্বত্থ, কাঁঠাল ইত্যাদি গাছ সমভূমিতে দেখা যায়।
5. বদ্বীপ অঞ্চলের উদ্ভিদ
১.অবস্থান: বেশিরভাগ উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনার সুন্দরবনের বদ্বীপ অঞলে এবং খুব সামান্য পরিমাণে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বঙ্গােপসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে এই জাতীয় উদ্ভিদ দেখা যায়।
২.বৈশিষ্ট্য: [i] এই জাতীয় উদ্ভিদের অরণ্য লবণাক্ত মাটিতে গড়ে ওঠে। এই অরণ্যের অপর নাম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। [ii] জরায়ুজ অঙ্কুরােদ্গম দেখতে পাওয়া যায়। [ii] শ্বাসমূল ও ঠেসমূল থাকে।
৩.প্রধান প্রধান উদ্ভিদ; সুন্দরী, গরাণ, গেওয়া, হেতাল, হােগলা, গােলপাতা, কেওড়া ইত্যাদি এখানকার উল্লেখযােগ্য উদ্ভিদ।
■ পশ্চিমবঙ্গের কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করাে।
পশিমবঙ্গের কৃষির বৈশিষ্ট্য:
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির। এই জলবায়ু সহ পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সামাজিক ও আর্থিক ব্যবস্থা এখানকার কৃষির প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এর ফলে এই রাজ্যের কৃমির কতকগুলি উঙ্কোশযােগ্য বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়ে, যেমন—
1. মৌসুমি বৃষ্টিপাতনির্ভর কৃষিকাজ — ১.বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর ওপর নির্ভর করে এই রাজ্যের অধিকাংশ জমিতে কৃষিকাজ করা হয়। এই সময়ের উৎপাদিত ফসলসমূহকে খারিফ ফসল বলে। ২. উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়ায় রাজ্যের বহু জায়গায় ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে গম, সরষে, যব প্রভৃতি রবি শস্যের চাষ করা হয়। ৩. মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার কারণে কোনাে কোনাে বছর শস্য চাষও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
2. প্রগাঢ় কৃষির প্রাধান্য :
পশ্চিমবঙ্গে জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বেশি বলে এখানে অল্প জমিতে অধিক শ্রমের বিনিময়ে অধিক ফসল উৎপাদন করা হয়।
3, জীবিকাসত্তাভিত্তিক কৃষি :
পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ কৃষিজ ফসলের চাষ করা হয় প্রধানত রাজ্যের চাহিদা পূরণের জন্য, রপ্তানি করে অর্থ উপার্জনের জন্য নয়।
4. খাদ্যশস্য, বিশেষত ধান চাষে প্রাধান্য : অত্যন্ত জনবহুল বলে পশ্চিবঙ্গের অধিকাংশ কৃষিজমিতে খাদ্যশস্যের চাষ করা হয়। রাজ্যের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ভাত বলে খাদ্যশস্যের মধ্যে ধানের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়।
5. শীতকালে আলু ও বােরাে ধান চাষের গুরুত্ব বৃদ্ধি :
বিগত কয়েক দশকে রাজ্যের বিভিন্ন অঞলে শীতকালীন কৃষিজ ফসল হিসেবে আলু ও বােরাে ধান চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। এই দুই ফসল উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হওয়ার ফলে এদের গুরুত্বও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
পশিমবঙ্গের কৃষির বৈশিষ্ট্য:
6. অর্থকরী ফসলের চাষ :
খাদ্যশস্য ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে পাট, চা, তামাক, কাজুবাদাম, রেশম, পান প্রভৃতি অর্থকরী ফসলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই ফসলগুলির মধ্যে পাট ও চা চাষের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
7. ফসল উৎপাদনের সাথে মৎস্য চাষ এবং গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি পালন : মাছ, মাংস, দুধ, ডিম প্রভৃতি প্রােটিনসমৃদ্ধ খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি রাজ্যের অধিকাংশ কৃষক পরিবারেই মৎস্য চাষ এবং গবাদিপশু ও হাঁস মুরগি। পালন করা হয়।
৪. সবুজ বিপ্লবের আভাস :
পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতাে পশ্চিমবঙ্গের ও কতকগুলি অঞলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করার ফলে ফসল উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই অবস্থা রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে।